লেন্সের পেছনের গল্প: ক্যামেরায় ধরা পড়া ৯/১১-এর বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির ছবি
ফটোসাংবাদিকতায় আমার ক্যারিয়ার জুড়ে, আমার তোলা ছবিগুলোর মানুষের পরিচয় খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। নিয়মিত কাজের ক্ষেত্রে, নিউজ ফটোগ্রাফাররা সাধারণত সাবজেক্টের (যার ছবি তোলা হয়) নাম এবং অন্যান্য তথ্য জিজ্ঞেস করতে পারেন, যা পরবর্তীতে ছবির শিরোনামের জন্য কাজে।
অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে এবং ছবি জমা দেওয়ার সময়সীমার চাপের কারণে ফটোসাংবাদিকরা সাবজেক্টের সঙ্গে কথা বলার সময় বা সুযোগ পান না;আর যদি কোনো সাংবাদিকের উপর ৯/১১ ঘটনার মতো কোনো দুর্যোগ নথিভুক্তির দায়িত্ব পড়ে, তাহলে সেই সুযোগ আরও বেশি অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এটি করা তাদের জন্য অনেক সময় অনিরাপদ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
কিন্তু এজেন্স ফ্রান্স প্রেসের (এএফপি) জন্য তোলা ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০০১ তারিখের একটি ছবি ছিল ভিন্ন।
নিউইয়র্ক শহরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার দিন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া টাওয়ারগুলোর একটিতে ধুলায় আচ্ছাদিত এক নারীর ছবি তুলেছিলাম আমি।
পরবর্তীতে এটি ৯/১১ ঘটনার অন্যতম প্রতীকী ছবি হয়ে ওঠে।
প্রথম টাওয়ারটি ভেঙে পড়ার পর ধুলো এবং কংক্রিটের যে বিশাল ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছিল পুরো এলাকাজুড়ে, সেখান থেকে বাঁচতে মানুষ বিল্ডিংয়ের লবিতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর সেখানেই আমি তার ছবি তুলেছিলাম।
তিনি একটি ব্যবসায়িক পোশাকে ছিলেন; কিন্তু ধুলো তার পোশাক এবং জুতার রঙকে অস্পষ্ট করে দিয়েছিল। তার গলার হারটিতে লবির আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। ছবিতে তার হাত দু'টি এমনভাবে দেখা যাচ্ছে, যেন তিনি আমার দিকে ইঙ্গিত করছেন।
ছবিটির উপরে হলদে একটি ছাপ পড়েছে; কিন্তু এটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। বাইরে সূর্যের আলোয় ছবি তোলার জন্য আমার ক্যামেরাটি সেট করা ছিল; তবে লবির ভিতরের কৃত্রিম আলোর কারণে ছবিটির উপরে হলদে একটা ভাব এসেছিল। সেদিনের পরে, ছবিটি জমা দেওয়ার তাড়াহুড়োয় আমি ছবির রঙ সংশোধন করতে পারিনি এবং যখন আমি এটি মুদ্রণে ছবিটি দেখলাম, তখন লক্ষ্য করলাম এই হলদে রঙটিই কীভাবে সেই ঘটনার ধ্বংসের অনুভূতি, ভয়ের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করছে।
ছবিটি তোলার পর, আমি দেখলাম অন্য লোকেরা তাকে একটি সিঁড়িতে উঠতে সাহায্য করছে; সম্ভবত একটি নিরাপদ স্থানে যেতে। আমি কখনও ভাবিনি এরপর তার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে।
কিন্তু ১১ই সেপ্টেম্বরের কিছুকাল পর আমি তার পরিচয় খুঁজে পেয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম।
৯/১১-এ ছবি তোলার অভিজ্ঞতা
সেই দিনটিকে শুধুমাত্র একটি বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ দিন হিসেবেই বর্ণনা করা যেতে পারে।
এএফপি'র একজন ফটোগ্রাফার আমাকে ফোন করে জানালেন, একটি বিমান মাত্রই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভিতরে বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম এটি একটি ছোট ব্যক্তিগত বিমান হবে।
সকালের ভিড়ের মধ্যেই আমি আমার ম্যানহাটন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সিটি হল স্টেশনের উদ্দেশ্যে একটি সাবওয়ে ট্রেনে উঠলাম। মনে হলো, ট্রেনের যাত্রা যেন চিরকালের জন্য শুরু হয়েছিল; স্বাভাবিক সময়ে যে পথ আধা ঘণ্টায় যাওয়ায়, সেটি যেতে আরও বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয়েছিল।
নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়েতে আরো কিছুক্ষণ দেরি হলো, সম্ভবত লোয়ার ম্যানহাটনে জরুরি অবস্থার কারণেই এমনটি হচ্ছিলো।
অবশেষে, প্রায় ৫০ মিনিট পরে আমি সিটি হলে পৌঁছেছিলাম।
নিচে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষকে আমি কয়েক ব্লক দূরের টুইন টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। ততক্ষণে দু'টি টাওয়ারের উপরতলায় আগুন লেগে গেছে। দক্ষিণের টাওয়ারটিতে দ্বিতীয় বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর তখনো আমি শুনিনি; তাই আমি খুবই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি টাওয়ারগুলোর বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম এবং আরও কিছু ছবি নেওয়ার জন্য ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
দক্ষিণে যেতে গিয়ে দেখলাম সেদিক থেকে শত শত মানুষের ভীর উত্তরের দিকে ধেয়ে আসছে। পুরো এলাকাজুড়ে সারাক্ষণ শুধু জরুরি যানবাহনগুলোর সাইরেন বেজে চলেছিল।
আমি টাওয়ারটির কাছে গিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম; এর মাঝেই হঠাৎ ট্রেনের শব্দের মতো প্রচণ্ড এক শব্দ শুনতে পেলাম। এটি ছিল প্রথম টাওয়ারটি ভেঙে পড়ার শব্দ।
টাওয়ারগুলো ভেঙে পড়ার সময় আমি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে মাত্র কয়েক ব্লকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম।
আমার আশেপাশের ভবনগুলোর মাঝে মেঘের মতো আচ্ছন্ন হয়ে ধুলোয় ভরে গেল; মানুষজন সেই মেঘের বাইরে ছুটতে লাগলো। এরপর পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, রাতের মতোই অন্ধকার। ঘন ধোঁয়া এবং ধুলো বাতাসে মিশে যাওয়ায় ঠিকমতো দেখতে পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছিল।
কাছাকাছি একটি অফিস ভবনের দিকে গেলাম আমি, সেখানে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখলাম সাধারণ মানুষকে ধোঁয়া থেকে বাঁচতে সাহায্য করছে। আমি নিজেও সেখান থেকে বের হতে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম।
কয়েকজন লোক লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের চেহারায় ছিল আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তির ছাপ। এক মিনিট বা তারও কিছু সময় পর, একজন নারী সেখানে প্রবেশ করলেন; সম্পূর্ণভাবে ধুলোয় মাখা ছিলেন তিনি। আমি স্বভাবতই তার ছবি তুললাম এবং বাইরে ফিরে গেলাম।
ধোঁয়া ততক্ষণে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল সবেমাত্র তুষারপাত হলো। রাস্তাঘাট, ভবন, গাড়ি, এমনকি মানুষসহ সবকিছুই ধুলোর হালকা আবরণে ঢাকা ছিল।
ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে মানুষ হেঁটে যাওয়া শুরু করলো বেশ শান্তভাবেই।
আর আমি দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় বন্দি করতে থাকলাম। সবাই একে অপরকে সাহায্য করছিল এবং এলাকা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল।
একটি সিটি বাস এসে থামল সেখানে; ভাড়া ছাড়াই বাসটি লোকজনকে উঠতে দিয়েছিল।
ব্যবসায়ী পোশাকে ব্রিফকেস হাতে ধ্বংস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন ব্যক্তির ছবি তুললাম আমি। আমার তোলা ৯/১১ ঘটনার ছবিগুলোর মধ্যে এই ছবিটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপরের দিনগুলো
কয়েক মাস পরে, ২০০২ সালের মার্চের প্রথম দিকে, ওয়াশিংটন ডিসির একজন এএফপি সম্পাদক, অফিসে আমাকে ফোন করে জানালেন, তারা আমার তোলা ছবির সেই নারীকে খুঁজে পেয়েছেন।
তার নাম মার্সি বর্ডার্স। বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং বিশ্বজুড়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার পর, ছবিটি তার পরিবারের নজরে আসে। এরপর তারা এএফপি'র ওয়াশিংটন ব্যুরোর একজন সম্পাদকে ফোন করে তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। আমি এএফপি'র নিউইয়র্ক সিটি ব্যুরোতে কাজ করতাম।
তার খোঁজ পেয়ে আমরা খুবই অভীভূত হয়েছিলাম। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হলো আমার।
অবশেষে, ২০০২ সালের মার্চের ২২ তারিখে এএফপির নিউইয়র্ক ব্যুরো প্রধান মিশেল মাউটোটকে সঙ্গে নিয়ে আমি বর্ডার্সের নিউ জার্সির বায়োনে, তার অ্যাপার্টমেন্টে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিলাম।
সেই ঐতিহাসিক দিনে, ধ্বংসস্তূপের মাঝে আমি যার ছবি তুলেছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে পারাটা আমার জন্য ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য। তবে আমি এটা জেনে স্বস্তি পেয়েছিলাম যে, তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন।
সেদিন পুরো এলাকাজুড়ে অনেক মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল। সেখানে একজন মানুষের বেঁচে যাওয়ার গল্প শোনাও ছিল স্বস্তিদায়ক।
২০০১ সালে ব্যাংক অফ আমেরিকায় চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বর্ডার্সের জীবন ছিল বেশ কঠিন। তার কার্যালয় ছিল টুইন টাওয়ারের একটি ভবনে। চাকরি পাওয়ার পর তিনি জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন মাত্র।
কিন্তু ৯/১১ তারিখের ঘটনায় সব বদলে গেলো। একটি বিমান নর্থ টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তিনি সেই ভবনের ৮১ তলায় কাজ করতেন এবং ভবনটি ধসে পড়ার আগেই পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আমরা মনোযোগ দিয়ে তার সব কথা শুনলাম। আমি তার অ্যাপার্টমেন্টের কয়েকটি ছবিও তুলেছিলাম; তার অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশ দরজার সঙ্গে আমেরিকার ছোট্ট একটি পতাকা লাগানো ছিল।
তিনি সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এমনকি বিমানের শব্দ শুনলেও তিনি ভয় পেতেন; উঁচু ভবনগুলোকে তিনি এতটাই ভয় পেতে শুরু করেছিলেন যে, আর কখনো লোয়ার ম্যানহাটনে ফিরবেন না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তাকে এতোটা ভয় পেতে দেখে আমরা কষ্ট পেয়েছিলাম। একটি উঁচু ভবনের ভিতরে যাওয়ার ভয় কাটিয়ে ওঠার লড়াইয়ে তিনি চাকরি হারাতে পারেন, এ ব্যাপারটি আমাদের কাছে অন্যায় মনে হয়েছিল।
এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের সময় তার সঙ্গে আমার আরো একবার দেখা হয়েছিল; তবে আমরা পরবর্তীতে আর যোগাযোগ রাখিনি। বছরের পর বছর আমি ৯/১১ বার্ষিকীতে গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার দেখতে পেতাম।
আমি সেদিন শত শত ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু বর্ডার্সের ছবিটি প্রতি বছর ৯/১১ তারিখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখানো হয়।
এই ছবিটি আমাকে প্রতিবার মনে করিয়ে দেয়, সেদিনটি কতটা বিশৃঙ্খল এবং বিভ্রান্তিকর ছিল। আমি এখনো এটা ভেবে অবাক হই, যে সামান্যতম আহত না হয়েই আমি ঘটনাটি কভার করতে পেরেছিলাম।
৯/১১ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের গল্পের মাঝে বর্ডার্সের গল্পটিও স্থান পেয়েছে। একজন মানুষ কীভাবে তার জীবনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এবং ভয়কে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন তার অন্যন্য প্রতীক হয়ে আছেন তিনি।
আমি মনে করি, অনেকই তার ছবিটি দেখে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করতে পারবেন।
২০১৫ সালের আগস্টে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বর্ডার্সের মৃত্যুর খবরে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলাম।
- লেখক স্টান হোনডা মার্কিন ফটোসাংবাদিক
- সূত্র: আল-জাজিরা