ধনী দেশের হাতে টিকার বিশাল মজুদ, অচিরেই ২৪ কোটি ডোজের মেয়াদ থাকবে না
মহামারি বিশ্ববাসীর সামনে অনন্ত দুর্ভোগের দুয়ার খুলে দেয়। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলাকালে জীবন ও জীবিকা হারিয়েছে লাখো মানব সন্তান। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হয় তীব্রতর। তবে শুধু সামাজিক জীবনে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও ধনী দেশগুলো করেছে টিকা নিয়ে বৈষম্য।
তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের অধিক-কার্যকর টিকা মজুদ থাকা সত্ত্বেও, তারা এগুলো নিম্ন আয়ের দেশকে প্রথমদিকে দেয়নি। এখন কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো কিছু পরিমাণে সরবরাহ শুরু করলেও, অঙ্গীকার ও প্রকৃত অনুদানের মধ্যে রয়েছে রাতদিনের পার্থক্য।
এ বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পৃথিবীর ৭০ শতাংশকে টিকাদানের মতো যথেষ্ট ডোজ অনুদানের অঙ্গীকার করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু, সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, ধনী দেশের হাতে এখনও এত বিপুল পরিমাণ মজুদ আছে, যা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে। ফেলে দিতে হবে কোটি কোটি ডোজ প্রাণদায়ী টিকা।
এ বাস্তবতায় জনমানষের দুর্ভোগ তুলে না ধরলেই নয়।
২০ বছর বয়সী ইরানি তরুণী বাহারের কথাই ধরুন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রবাসী এ তরুণী গত বছরের গ্রীষ্মের শুরুতে চার বছর পর প্রথম ইরানে আসেন। সে সময় তিনি জানতেনও না, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ তার নিজের দেশ ও পরিবারকে কীভাবে বিপর্যস্ত করতে চলেছে।
প্রথমেই মারা যান পারিবারিক বন্ধু এক নারী, যিনি ভাবতেও পারেননি এভাবে মৃত্যু তাঁর জীবন প্রদীপ নেভাবে। নির্ভার হয়ে ছেলের বিয়ের আয়োজন করছিলেন মহিলাটি। আর এ প্রস্তুতির সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর অন্ধকার নেমে আসে দিনকয়েক পরেই।
এরপর মারা যান, বাহারের বাবার এক চাচা। তারপর এক বয়স্কা চাচী। বাহার নিজের বয়স্কা দাদীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বাহারের দাদী মাত্র এক ডোজ টিকা নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা এই বৃদ্ধা আক্রান্ত হওয়ার আগের দিনগুলো তার ছেলে, অর্থাৎ বাহারের বাবার বাড়িতেই কাটান।
যুক্তরাষ্ট্রবাসী হওয়ায় দুই ডোজ টিকাই পেয়েছিলেন বাহার, কিন্তু ইরানে রয়েছে টিকা ডোজের স্বল্পতা।
বাহার দেশে ফেরার কিছুদিন পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা। এসময় ভীষণ অপরাধবোধ গ্রাস করে বাহারকে।
এ তরুণী বলেন, "শুধু আমিই সুরক্ষিত, এ অপরাধবোধ আমাকে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ করছিল।"
ফাইজারের দুই ডোজ টিকা নেওয়া বাহার আক্রান্ত না হয়েই ইরান ত্যাগ করেছিলেন অবশেষে। তার বাবাও সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু পরিবারের অনেক বয়স্ক আর বাঁচতে পারেননি। মারা যান তার প্রিয় দাদীও।
পরদেশে বসে এসব কথা জেনে আরও অনুশোচনা বেড়েছে বাহারের, সেকথাও জানান অকপটে।
এ ছিল কেবল একটি দেশের, একটি পরিবারের দুর্ভোগ। মহামারির এ ভয়াল রূপে আমরা প্রায় সকলেই কোন না কোন আপনজনকে হারিয়ে যেতে এদেশেও দেখছি। অথচ, সময়মতো উন্নত মানের টিকাগুলো আসলে, তাদের অনেকেই হয়তো আজ আমাদের মাঝে থাকতেন।
টিকা সরবরাহের এ বৈষম্যে পরিসংখ্যানের তথ্যেও স্পষ্ট। এখনও বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এক ডোজ টিকাও পাননি।
মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ৭৫ শতাংশ টিকা ডোজের সরবরাহ পেয়েছে মাত্র ১০টি দেশ।
দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসাব অনুসারে, এপর্যন্ত উৎপাদিত টিকার অর্ধেক হাতে আছে বিশ্বের মাত্র ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে। এসব ধনী জাতিরা দরিদ্র দেশের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি দ্রুতগতিতে টিকা দিচ্ছে।
এনিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তার ওপর টিকা সরবরাহ করে রাশিয়া ও চীন দরিদ্র দেশে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে, এটাই হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের মাথাব্যথার প্রধান কারণ। ফলে অনেক দেরীতেহলেও, তারা ধীরে ধীরে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করে।
গত জুনে শিল্পোন্নত জি-সেভেন জোটের সদস্য- কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে শত কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের অঙ্গীকার করে।
কিন্তু, এ অঙ্গীকারকে অনেক অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞই তখন পরিহাস মনে করেছিলেন। নিজের এমন অনুভূতির কথাই জানান- ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক টিকা সরবরাহ নিয়ে সদ্য প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের মূল লেখক আগাথে ডেমারিস।
সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, "তাদের ঘোষণা শুনে হাসি পাচ্ছিল। আমি জীবনে এসব জিনিস অনেক দেখেছি-শুনেছি। জানি কোনদিনই এসব অঙ্গীকার পূরণ হয় না।"
জি-সেভেন সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্য সেসময় ১০ কোটি ডোজ অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু, এপর্যন্ত অনুদান দিয়েছে মাত্র ৯০ লাখ।
বাইডেন ৫৮ কোটি ডোজ দেওয়ার ঘোষণা দিলেও, এপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ১৪ কোটি ডোজ। অন্যদিকে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ ২৫ কোটি ডোজ অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপিয় ইয়নিয়ন। কিন্তু, এপর্যন্ত কোভ্যাক্স জোটকে অঙ্গীকারের মাত্র ৮ শতাংশ সরবরাহ করেছে।
মধ্য-আয়ের অনেক দেশের মতোই কোভ্যাক্স থেকে টিকার ডোজ কিনেছে ইরান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) এ উদ্যোগ যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি দরকার, তাদের ন্যায্য মূল্যে টিকা সরবরাহের লক্ষ্যে গঠিত হয়।
কোভ্যাক্স টিকা কিনে, কম দামে মধ্য আয়ের দেশে বিক্রি করে ও দরিদ্র দেশকে বিনামূল্যে সরবরাহ করছে।
কিন্তু, শুরু থেকেই উৎপাদক দেশের জাতীয়তাবাদী মনোভাবে, ব্যাহত হয় কোভ্যাক্স কার্যক্রম। চলতি বছর বা ২০২১ সাল নাগাদ ২০০ কোটি ডোজ সরবরাহের লক্ষ্য থাকলেও, করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেওয়া মাত্রই টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার। অথচ, বিশ্বের প্রধানতম টিকা উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতেই অবস্থিত। সংস্থাটি কোভ্যাক্সের কাছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিক্রির চুক্তিও করেছিল।
তারপর থেকেই বাধ্য হয়ে ধনী দেশের দেওয়া টিকা অনুদানের ওপর নির্ভর করছে কোভ্যাক্স। আর দেশগুলো দিচ্ছেও অনেক ধীর গতিতে। অথচ, কোভ্যাক্স থেকে সহায়তা পাওয়া অনেক দরিদ্র দেশে এখনও মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশও টিকা পায়নি।
কোভ্যাক্স কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরিয়েলা নগুয়েন বলেন, 'বর্তমানে স্বল্প সময়ের নোটিশে খুব কম পরিমাণে ডোজ আমাদের দেওয়া হচ্ছে। ফলে এগুলো যেসব দেশে প্রয়োজন, সেখানে পরিবহনের ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়ছি, হাতে আসামাত্র নিজ জনগণকে এসব টিকাদানেও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে অনুন্নত দেশের সরকার।'
এটি কোন বৈশ্বিক সরবরাহের সমস্যা নয়, বরং ইচ্ছেকৃত কৃচ্ছতার ফসল।
বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষক কোম্পানি- এয়ারফিনিটির মতে, ধনী দেশের হাতে বিশাল মজুদের ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। শীর্ষ টিকা উৎপাদক কোম্পানিগুলো প্রতিমাসে ১৫০ কোটি টিকা প্রস্তুত করছে, আর চলতি বছরের শেষ নাগাদ মোট উৎপাদিত হবে ১ হাজার ১০০ কোটি ডোজ।
এয়ারফিনিটির প্রধান গবেষক ড. ম্যাট লিনলে বলেন, "তারা বিপুল সংখ্যায় (কোভিড) টিকা ডোজ উৎপাদন করছে। গত তিন থেকে চার মাসে তাদের উৎপাদন সক্ষমতাও অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে। বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এ মুহূর্তে ধনী দেশগুলোর হাতে এমন ১২০ কোটি ডোজ রয়েছে, যা তাদের দরকার হবে না।"
এই ১২০ কোটির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বা ২৪ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দ্রুত অনুদান না দিলে, নষ্ট হতে পারে বলেও উল্লেখ করেন ড. লিনলে।
তার মতে, মেয়াদ উত্তীর্ণের অন্তত দুই মাস সময় না আসা পর্যন্ত এগুলো অনুদান দেওয়া হবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সরবরাহে দেরীসহ অবকাঠামো সমস্যায় কার্যকারিতা হারাতে পারে ডোজগুলো।
"ধনী দেশগুলো টিকা নিয়ে লোভীর মতো আচরণ করায় এমনটা হচ্ছে বলে মনে করি না। আসলে তারা প্রথমদিকে জানতো না, কোন টিকাটি অধিক ফলপ্রসূ। একারণেই তারা বেশি করে প্রায় সকল কোম্পানির টিকা কিনে রেখেছে।"
তবে সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে এয়ারফিনিটি ধনী দেশের সরকারকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে চাইছে। গবেষণার মূল লক্ষ্যই ছিল, দ্রুত অনুদানে তাদের উৎসাহিত করা। একইসঙ্গে, বিপুল সরবরাহের তথ্য তুলে ধরে কোম্পানিটি দেখিয়েছে যে, এখন বড় অংকে অনুদান দিলেও, আগামী মাসগুলোয় উচ্চ-উৎপাদনের কারণে সে শূন্যতা পূরণ হয়ে যাবে।
আগাথে ডেমারিস বলেন, "ধনী দেশের সরকার অসতর্ক অবস্থায় পড়তে চায় না। হঠাৎ বড় অংকে টিকা দেওয়া শুরু করলে তারা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখেও পড়বে। দুঃখের বিষয়, অনেক উন্নত দেশের মানুষ চান না তাদের করের টাকায় কেনা টিকা এত উদারভাবে বিলি করা হোক। তাছাড়া, নিজ দেশে টিকার চাহিদা থাকা অবস্থায় এমনটা না করার পক্ষেই আছে জনমত।"
কোভ্যাক্সের শীর্ষ কর্মকর্তা অরিয়েলা নগুয়েন মনে করেন, শুধু উন্নত দেশের সরকারের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়।
"টিকা উৎপাদক কোম্পানিগুলোর কোভ্যাক্সকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণেও চাপে রাখতে হবে। যেসব দেশের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ আছে, তাদের সাথে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পূরণের চাইতে কোভ্যাক্সে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিক্রিতে তাদের বাধ্য করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "বৈশ্বিক টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো যদি মাসে ১৫০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করে, তাহলে দরিদ্র দেশে এত কম পরিমাণে কেন টিকা দেওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্ন ওঠে। "এসব দেশেই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার। বড় অংকের অর্ডার বুক করা সরকারগুলোর লাইনের পেছনে সরে এসে কোভ্যাক্সকে জায়গা করে দিলে, আমরা বিপন্ন মানুষের পাশে কার্যকর টিকা নিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাব।"
- সূত্র: বিবিসি