করোনা চিকিৎসায় শীঘ্রই আসতে পারে মুখে খাওয়া ওষুধ
করোনা প্রতিরোধে টিকার পাশাপাশি শুরু হয়েছে 'ওরাল পিল' বা মুখে খাওয়ার ওষুধ তৈরির গবেষণা। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ও ওষুধ উন্নয়ন কোম্পানিগুলো এ গবেষণা শুরু করেছে। বর্তমানে, অন্তত তিনটি অ্যান্টিভাইরালের গবেষণা চলছে, যার ফলাফল সামনের হেমন্তে কিংবা শীতের মাঝেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে অতি পরিচিত ফাইজার বায়োটেকও।
চলতি বছরের জুনে, ৪৪ বছর বয়সী মিরান্ডা কেলি হঠাৎই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার সূত্র ধরে, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান। কারণ তার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ছিল। সার্টিফায়েড নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট কেলির শ্বাসকষ্ট, মারাত্মক কাশি ও অন্যান্য করোনা উপর্সগ নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
এরই মধ্যে তার স্বামী জো (৪৬) কোভিড-১৯ সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়লে, তারা দু'জনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন; কারণ তাদের সংসারে রয়েছে কিশোর বয়সী পাঁচ সন্তান। মৃত্যু ভয়ে কাতর এই দম্পতি চিন্তায় পড়ে যান, তাদের কিছু হয়ে গেলে পাঁচ সন্তানের দেখাশোনা কে করবে!
তবে এত সব চিন্তার মাঝেও সিয়াটেলবাসী কেলি মিরান্ডা, শহরের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিতে রাজি হয়ে গেলেন। ট্রায়ালটি ছিল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মুখে খাওয়া ওষুধ উদ্ভাবনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার একটি অংশ।
পরের দিন থেকে এই দম্পতি প্রতিদিন দু'টি করে চারটি ট্যাবলেট সেবন করতে শুরু করেন। যদিও তখন তাদের জানানো হয়নি, তাদেরকে আসলে কোনো কার্যকর ওষুধ দেওয়া হচ্ছে নাকি প্লাসিবো (প্রকৃত ওষুধের মতোই; তবে এটি শুধু পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার হয়)। প্রতিদিন দুইটি করে ওষুধ সেবনের এক সপ্তাহ পর, তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের যে লক্ষ্মণ ছিল তা কিছুটা কমে আসতে শুরু করে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
মিরান্ডা কেলি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিনি জানেন না যে তারা ওষুধ পেয়েছেন নাকি অন্যকিছু; তবে তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কেলি এবং জো দম্পতির প্রতিদিনের এই দু'সপ্তাহের প্রচেষ্টা পুরো বিশ্বের কাছে কোভিড-১৯ মোকাবেলার আরেকটি বিকল্প পথ দেখিয়ে দিয়ে গেলো।
ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা-চ্যাপেল হিলের ভাইরোলজিস্ট এবং এই গবেষণার অংশীদার প্রফেসর টিমোথি শেহান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "মুখে খাওয়ার এই ওষুধ কেবল করোনার উপসর্গই কমাবে না, বরং আপনি আক্রান্ত হওয়ার পরও এটি আপনার ঘরের অন্য সদস্যদেরকে আক্রান্ত করার সম্ভাবনাকে যথেষ্ট কমিয়ে দেবে।"
হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি এবং অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল একটি অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা। এরমধ্যে টামিফ্লু অন্যতম একটি ওষুধ, যা ইনফ্লুয়েঞ্জার স্থায়িত্ব কমানোর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকিও হ্রাস করে।
মানুষ ও পশুর মধ্যে ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় এ ওষুধের উদ্ভাবন হয়েছে; তবে ভাইরাসের ধরন অনুযায়ী এটি শরীরে ভিন্নভাবে কাজ করে থাকে। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে এবং শরীরের সুস্থ কোষে ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকায়। সেইসঙ্গে এটি ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে দিতেও সহায়তা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের এইডস বিভাগের পরিচালক কার্ল ডিফেনবাচ বলেন, নতুন ধরণের কোভিডের চিকিৎসা উদ্ভাবনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ হিসেবে কমপক্ষে তিনটি সম্ভাবনাময় অ্যান্টিভাইরালের পরীক্ষা চলছে।
তিনি আরো বলেন, "আমি মনে করি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা সেগুলোর ফলাফল জানতে পারব।"
তিনটি অ্যান্টিভাইরালের মধ্যে একটি হলো, মার্ক অ্যান্ড কোং এবং রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিক্সের 'মলনুপিরাভির'। সিয়াটেলের কেলি দম্পতির উপর এ ওষুধটিরই পরীক্ষা চালানো হয়েছে। অন্য দু'টির মধ্যে একটি হলো ফাইজারের, যার সাঙ্কেতিক নাম দেওয়া হয়েছে পিএফ-০৭৩২১৩৩২ এবং সর্বশেষটি হলো, রোশ এবং এ্যাটেয়া ফার্মাসিউটিক্যালসের এটি-৫২৭। গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিফেনবাচ।
এই অ্যান্টিভাইরালগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে, মানবকোষে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত রেমডিসিভির নামের একটি মাত্র অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে এটি কেবল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা গুরুত্বরভাবে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে। অন্যদিকে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের এই ওষুধগুলো ইতিবাচক ফলাফল আনলে, তা মুখে খাওয়া ওষুধের মতোই ব্যবহার করা যাবে।
প্রফেসর শেহান রেমডিসিভিরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, মলনুপিরাভির কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ধাপের চিকিৎসাই ব্যবহার করা যেতে পারে।
গত বসন্তে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২ জন সেচ্ছাসেবীর শরীরে ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা দ্রুত কমিয়েছে মলনুপিরাভির।
গত ১ সেপ্টেম্বর, ফাইজার একই সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করেছে। অন্যদিকে, এ্যাটেয়া কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা চলতি বছরের শেষের দিকে তাদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ের ফলাফল পেতে চলেছেন।
এ ব্যাপারে মার্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানি এ বছরান্তে ১০ মিলিয়নেরও বেশি কোর্স তৈরি করার সক্ষমতা রাখে। তবে এ্যাটেয়া এবং ফাইজার এধরণের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী এখনও করেনি।
এই গবেষণা সফলভাবে শেষ হলে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতে পারবেন বলে আশা করছেন গবেষকরা।
সূত্রঃ সিএনএন