ইন্টারনেট মোগলদের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করছে চীন
চীনের বৃহত্তম ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করছে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই কোম্পানিগুলোর সম্পদও ব্যবহার করছে চীন সরকার।
২০২০ সালে তথ্য নিরাপত্তা ও মনোপলি বা একাধিপত্য বিরোধী ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে এসব টেক কোম্পানিগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছিল চীন সরকার। এর আগে টানা দুই দশক তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণের শিকার না হয়েই বিকশিত হতে পেরেছিল কোম্পানিগুলো।
এই ক্র্যাকডাউনের পর ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আলিবাবা, ভিডিও গেম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টেনসেন্ট এবং অন্যান্য কোম্পানি থেকে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ সরিয়ে নিয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ একাধিপত্য বিরোধী নীতিগুলোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাদের মতে, মনোপলি না থাকলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, এবং এর ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই নীতি থেকে শি জিনপিং সরকার সরে আসবে না বলেই মনে করছে ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং অর্থনীতিবিদরা। ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের প্রধান এশিয়া-বিষয়ক অর্থনীতিবিদ মার্ক উইলিয়ামস বলেন, "উদ্ভাবনের বেলায় এই কোম্পানিগুলো বিশ্বে নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে আছে। কিন্তু এরপরও (চীনা) সরকার তাদের সবাইকে পিষে ফেলতে চাইছে।"
লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের চীনা রাজনীতি বিশেষজ্ঞ স্টিভ সাং বলেন, "অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পার্টির 'মূল লক্ষ্য'-কে পুনরুজ্জীবিত করতে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দেওয়া শি'র প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন এই ক্র্যাকডাউন। দলীয় নেতা হিসেবে শি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পরিকল্পনা করে থাকলে এই অভিযান তাকে রাজনৈতিকভাবেও সাহায্য করতে পারে বলে মনে করছেন স্টিভ।"
আইনজীবী সংস্থা উইলমারহেলের বেইজিং অফিসের প্রধান লেস্টার রস বলেন, "চীনা নেতারা এসব বেসরকারি কোম্পানিদের ওপর অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ পুনরায় চাপিয়ে দিতে চান না, তবে ক্ষমতাসীন দলের পরিকল্পনার সঙ্গে তাদের সামঞ্জস্য থাকুক সেটি প্রত্যাশা করেন।"
রস বলেন, "কোম্পানিগুলো বেশি বড় হয়ে যেতে পারে, বেশি স্বাধীন হয়ে যেতে পারে; এ ব্যাপারগুলো নিয়ে ভয় পাচ্ছে তারা।"
জ্যাক মা'র আলিবাবা গ্রুপ এবং পনি মা'র টেনসেন্ট হোল্ডিংস-সহ একাধিক চীনা ইন্টারনেট কোম্পানি গত দুই দশকে বৈশ্বিকভাবে নিজেদেরকে সেরাদের সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমানে আলিবাবা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স কোম্পানি, এবং টেনসেন্ট বহুল জনপ্রিয় উইচ্যাট মেসেজিং পরিষেবা পরিচালনা করে যাচ্ছে।
কিন্তু এখন চীন সরকার রোবট, চিপস এবং অন্যান্য হার্ডওয়্যারের উপর জোর দিচ্ছে, যে কারণে এ কোম্পানিগুলো তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য এসব খাতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে যাচ্ছে।
বিশ্ব বিভক্ত হয়ে যেতে পারে, ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণায় এই হুঁশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছে। তারা ধারণা করছেন, সব ধরনের প্রযুক্তি পৃথক বাজারে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। হতে পারে, চীনের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে কাজ করবে না, এবং মার্কিন ও ইউরোপীয় পণ্য চীনে কাজ করবে না। যে কারণে উদ্ভাবন এবং কারিগরি দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আলিবাবা জানিয়েছে, তারা অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার, প্রসেসর চিপস এবং নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি বিকাশে ২৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া, আগামী তিন বছরে এক লাখ ডেভেলপার ও স্টার্টআপকে বিকশিত করতে ১০০ কোটি ডলার খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কোম্পানিটি।
টেনসেন্ট ডিজিটাল অবকাঠামোতে ৭০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে গত বছর। ই-কমার্স প্লাটফর্ম মেইটুয়ান স্বচালিত যানবাহন এবং রোবট তৈরির জন্য মোট এক হাজার কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে।
সাং বলেন, চীনের সরকারি কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন যে এসব প্রকল্প চীনকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কথা বলতে রাজি নয়। "কার এমন সাহস আছে যে শি জিনপিংকে গিয়ে বলবে, আপনার নীতি চীনের জন্য ক্ষতিকর হবে?" বলেন সাং।
গত নভেম্বরে আলিবাবার আলিপে অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস থেকে বেড়ে ওঠা অ্যান্ট গ্রুপকে হংকং এবং সাংহাইয়ের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে শুরু হয় এই ক্র্যাকডাউন। অনলাইনে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সেবা প্রদানকারী কোম্পানিটিকে তাদের পরিকল্পনা দমিয়ে নিতে এবং ঋণ গ্রহণকারীদের জন্য ব্যাংকের মতো ব্যবস্থা স্থাপন করে ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে শি জিনপিং সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলোর দ্বারা সংগৃহীত জনসাধারণের তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে। বিশেষ করে আলিবাবা এবং টেনসেন্টের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে তারা, কেননা তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
দেশের ১৪০ কোটি মানুষের তথ্যকে জনসাধারণ এবং অর্থনীতি বিষয়ক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন চীনা নেতারা। এসব তথ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকায় সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েও চিন্তিত তারা।
১ নভেম্বর কার্যকর হতে যাওয়া একটি আইন অনুযায়ী, কোম্পানিগুলো গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া তাদের তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না, এবং গ্রাহকের ব্যাপারে তাদের তথ্য সংগ্রহ সীমিত করতে হবে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর তথ্য সুরক্ষা আইনের মতো ব্যক্তিগত তথ্য সরকার বা শাসক দলের হাতে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি এই আইনে।
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়ন চালাতে জনসাধারণের তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অ্যান্টি-মনোপলি বিশেষজ্ঞ অ্যাঞ্জেলা ঝাং এ মাসের একটি গবেষণাপত্রে লিখেছেন, কয়েক মাস আগেও "খুব শিথিল" থাকা চীন "ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সক্রিয় এবং জোর-জবরদস্তিমূলক আইনগুলোকে এখতিয়ারে পরিণত করেছে।"
সম্প্রতি আলিবাবা, টেনসেন্ট, লাইভ-স্ট্রিমিং সাইট কুয়াইশো, মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম সিনা ওয়েইবো এবং সোশ্যাল মিডিয়া সাইট জিয়াওহংশুকে শিশুদের যৌন উত্তেজক স্টিকার বা ছোট ভিডিও বিতরণের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। টেনসেন্টের সঙ্গীত পরিষেবাকে গ্রাহকদের 'এক্সক্লুসিভ' চুক্তিতে সেবা দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চীনের রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সম্পদের ব্যবধান কমানোর পদক্ষেপও নিয়েছে বেইজিং। এই মর্মে বড় কোম্পানিগুলোকে তাদের সম্পদ কর্মচারী এবং ভোক্তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত মে মাসে দিদি, মেইটুয়ান এবং অন্যান্য ডেলিভারি এবং রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে চালকদের বেতন বাড়ানোর এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা প্রটোকলে অগ্রগতি আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেইটুয়ানের প্রধান নির্বাহী ওয়াং জিং পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগে ২৩০ কোটি ডলার দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। টেনসেন্টের প্রধান নির্বাহী পনি মা দাতব্য কাজে ২০০ কোটি ডলার দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শি'র "সাধারণ সমৃদ্ধি" অভিযানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে আলিবাবা গ্রুপ জনগণের জন্য নতুন কর্মস্থান তৈরি, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং অন্যান্য উদ্যোগের জন্য মোট ১৫৫০ কোটি ডলার ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ঝাং লিখেছেন, "এই ধরনের আয় পুনর্বণ্টন পরিকল্পনা '৫০ ও '৬০ দশকে মাও সে তুংয়ের নেওয়া গণসংহতি এবং জনবাদী নীতিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।"
- সূত্র: এপি