২০৪০ সাল নাগাদ পারমাণবিক শক্তিচালিত-সহ সকল ধরনের সাবমেরিন সেকেলে হয়ে পড়বে!
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তি সহায়তায় সম্প্রতি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণের চুক্তি করেছে অস্ট্রেলিয়া। নৌবাহিনীতে নতুন এ সক্ষমতা দেশটি যুক্ত করবে প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের প্রভাব মোকাবিলায়। ২০৪০ সাল থেকে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভির সার্ভিসে যুক্ত হতে শুরু করবে স্থানীয়ভাবে তৈরি বিদেশি প্রযুক্তির ডুবোজাহাজগুলো। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ওই সময় নাগাদ পানির নিচে দেখার প্রযুক্তি এত বিকশিত হবে, যার ফলে ডুবোযান সহজেই শনাক্ত করা যাবে।
অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ফ্রান্সের সঙ্গে ৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি মূল্যের প্রচলিত শক্তিচালিত সাবমেরিন ক্রয়ের চুক্তি করেছিল। কিন্তু, সেটি বাতিল করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'অকাস' চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া সরকার। ২০৪০ সালের সময়সীমা থেকে ডুবোযানগুলোকে যুদ্ধোপযোগী ও বহরে যুক্ত করা ছিল এ সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ।
কারণ, ওই সময়েই অস্ট্রেলীয় নেভির সার্ভিসে থাকা কলিন্স ক্লাস সাবমেরিনগুলোর আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাবে। তখন একে একে সেগুলোকে নতুন ডুবোযান দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে।
তবে ফ্রান্সের সঙ্গে বাতিল হওয়া চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই সামরিক বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ডুবন্ত ড্রোন ও জলতলে ব্যবহার উপযোগী নতুন অস্ত্রসজ্জার প্রভাবে, সব ধরনের সাবমেরিন মান্ধাতার আমলের উপকরণে পরিণত হবে। নৌবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির চেয়ে দায় বাড়াবে এ ধরনের রণতরী।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আগামীদিনের শনাক্তকরণ প্রযুক্তি সমুদ্রকে প্রায় 'স্বচ্ছ' করে তুলবে, এখানে স্বচ্ছতা বলতে শনাক্তের সক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। ফলে শত্রুবাহিনীর সবচেয়ে 'স্টিলথ' বা সঙ্গোপনে চলাচলের প্রযুক্তিধারী সাবমেরিনের অবস্থান ও গতিবিধি জানা যাবে।
এনিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধীন জাতীয় নিরাপত্তা কলেজের বিশেষজ্ঞরা 'ট্রান্সপারেন্ট ওশেন্স' শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে তারা সমুদ্রের জলরাশির নিচে এই দেখার ক্ষমতাকেই 'স্বচ্ছতা' বলেছেন। ২০৫০ সাল প্রযুক্তিটি অত্যন্ত উন্নতমানের হবে বলে তারা মতপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ, অস্ট্রেলিয়ার নতুন পরমাণু চালিত সাবমেরিন বহর সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার এক দশক পরই প্রশ্নবিদ্ধ হবে সেগুলোর কার্যকারিতা।
সামরিক সরঞ্জামের নানান দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। তারা ইলেক্ট্রনিক সেন্সর, জলতলে যোগাযোগ শনাক্তকরণসহ সামুদ্রিক চলাচল পথের বিশেষ বিশেষ সংকীর্ণ জায়গায় সাবমেরিন শনাক্ত করে সংকেত পাঠানোর মতো প্রযুক্তির বিকাশকে আমলে নেন।
এছাড়াও, জলরাশিতে সাবমেরিন চলাচলের ফলে সৃষ্ট রাসায়নিক, জৈবিক, শব্দগত ও তাপজনিত চিহ্ন শনাক্তের নতুন প্রযুক্তিগুলোও তারা পরীক্ষা করেছেন। সবকিছু বিচার-বিবেচনার পর তাদের অভিমত, যতই উন্নত ব্যবস্থা থাকুক, আর দুই- তিন দশক পর সবচেয়ে গোপনে চলাচলকারী সাবমেরিনও আর চীনের মতো শক্তিশালী শত্রুর চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, "ভবিষ্যতের প্রযুক্তি সাগরতলকে অনেকখানি স্বচ্ছ করে তুলবে, এসময় শনাক্তকরণ বিরোধী প্রযুক্তিও এখনকার মতো সফলভাবে কাজ করতে পারবে না।"
তাছাড়া, ইতোমধ্যেই ডুবোযান শনাক্তকারী লেজার রশ্মি তৈরি করেছে চীন। চীনের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট এমন একটি স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি তৈরি করেছে যা সাগরের ৫০০ মিটার গভীরে ডুবোযান শনাক্ত করতে পারে।
এব্যাপারে সিডনি ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লোয়ি ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালবার্ট পালাজ্জো বলেন, "খুব শিগগির চীনের এ প্রযুক্তি এত উন্নত স্তরে পৌঁছাবে, যার ফলে পানির নিচ থেকে অস্ট্রেলীয় সাবমেরিন ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার প্রস্তুতি নেওয়া মাত্র- এটির অস্তিত্ব প্রকাশ হয়ে যাবে, এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবোযানটিকে ধবংস করে দেওয়া হবে।"
তবে সব বিশেষজ্ঞই নিরাশ নন। অনেকেই মনে করেন সাবমেরিন নতুন ও ক্রমবিকাশমান প্রযুক্তিবাহী মূল প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
এনিয়ে সাবমেরিন ইনস্টিটিউট অব অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্ক স্যান্ডার মন্তব্য করেন, আগামীদিনে সাবমেরিন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও শত্রুর গতিবিধি জানার গুরুত্বপূর্ণ ধারক হবে, তাঁর সাথে থাকবে হামলা প্রতিরোধ ও আক্রমণ চালানোর শক্তি।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, "প্রতিনিয়ত অস্ত্র, সেন্সর ও সেন্সর থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের প্রযুক্তি উন্নততর হচ্ছে।"
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের বিদায়ী প্রধান পিটার জেনিংস বলেন, "পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিনে অনেক বেশি জায়গা থাকে, তাই এতে বেশকিছু জলচর রোবট বা চালকহীন ছোট ডুবোযান রাখা যায়, যা টর্পেডো টিউব থেকেও লঞ্চ করা সম্ভব। সাবমেরিন শত্রু এলাকার শত শত কিলোমিটার নিরাপদ দূরত্ব থেকে এসব যানের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে, এবং সেগুলো নিজ নৌবহরের অন্যান্য জাহাজের সঙ্গে বিনিময় করবে।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান