টেপ টেনিসের আঙিনা ছাড়িয়ে জয়-রাজার টেস্ট দলে আসার গল্প
টেনিস বলে শুরু, সেটার ওপর প্রলেপ পড়ে টেপের। আঙিনা বড় হয়, বাড়তে থাকে স্বপ্ন। এক পা, দু পা করে পথ মাড়ানো, সেটাই হয়ে ওঠে স্বপ্নের পথ। সে পথে হাঁটতে হাঁটতে যে বাঁকটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন মাহমুদুল হাসান জয় ও রেজাউর রহমান রাজা, সেই বাঁকে পৌঁছাতেই তপস্যা করে যান ক্রিকেটাররা।
বাংলাদেশের টেস্ট দলে ডাক মিলেছে এই দুই ক্রিকেটারের। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের জন্য ঘোষণা করা ১৬ সদস্যের দলে ডাকা হয়েছে জয়-রাজাকে। টেস্ট আঙিনায় পা রাখা এই দুই ক্রিকেটারেরই শুরু হয়েছিল টেপ টেনিসে।
সেখান থেকে বিকেএসপি হয়ে যুব দলে নাম লিখিয়ে বিশ্ব জয়ের একজন হন জয়। সেমি-ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ এক সেঞ্চুরি করেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। রাজার গল্পটা আবার ভিন্ন। টেপ টেনিসের বোলিং দিয়েই সবাইকে মুগ্ধ করে পেশাদার ক্রিকেটে জায়গা করে নেন তিনি।
মাহমুদুল হাসান জয়
মাহমুদুল হাসান জয়ের গল্পটা তার যুব দলের অনেক সতীর্থের সঙ্গেই মিলে যায়। বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে যেতে হতো তাকে। কিন্তু মাঠে গিয়ে ব্যাটিং না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতেন তিনি। জিদটা পুষে রেখেছিলেন যুব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০ রানের ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তোলা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে জন্ম নেয়া মাহমুদুলের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা দেখে বাবা ব্যাংকার আবুল বারেক তাকে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করান। চাঁদপুরের এই একাডেমিতে দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন মাহমুদুল। ছেলেকে নিজের মতো ব্যাংকার বানানোর স্বপ্ন ছেড়ে বাবা আবুল বারেকও সব ধরনের সমর্থন দিতে থাকেন। এরপর কেবল এগিয়ে যাওয়ার গল্পই লিখেছেন মাহমুদুল।
টেস্ট দলে ডাক পেয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই জয়ের, 'আসলে এই অনুভূতিটা প্রকাশ করার মতো না। সবারই স্বপ্ন থাকে টেস্ট স্কোয়াডে চান্স পাওয়ার। আমি প্রথমবারের মতো টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছি। আমি অনেক খুশি। কিভাবে কী করবো, সেটি নিয়ে আলাদা কোন পরিকল্পনা নেই। সুযোগ পেলে আমি আমার স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ের চেষ্টা করবো।'
জাতীয় ক্রিকেট লিগে দারুণ সময় কেটেছে জয়ের, তিন ম্যাচেই করেছেন ৩৪৫ রান। জাতীয় লিগের দূর্দান্ত পারফরম্যান্সে আত্মবিশ্বাসী তরুণ এই ব্যাটসম্যান, 'জাতীয় লিগে বেশ কয়েকটি ভালো ইনিংস খেলেছি। আমার আত্মবিশ্বাস এখন ভালো আছে। তার আগে এইচপি ও 'এ' দলের প্রস্তুতি ম্যাচেও আমি ভালো একটা ইনিংস খেলেছি। তাই আমি প্রস্তুত আছি, সামনের ম্যাচগুলোতে ভালো খেলার জন্য।'
অনুশীলনে দলের সবার কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন জয়। তার ভাষায়, 'সিনিয়র ভাইরা সবাই আছেন, সবাই সাহায্য করলে... আমরা একসাথে শেষ কয়েকটা সিরিজ খেলছি। সবাই অনেক সাহায্য করে আমাকে, ভালো কিছুর আশায় আছি।'
রেজাউর রহমান রাজা
ডানহাতি এই পেসারের গল্পটা জয়ের পুরোপুরি বিপরীত। জয় ব্যাটিং না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু রাজা তার বোলিংয়ে সবাইকে মুগ্ধতার ঘোরে ফেলে দিতেন, সিনিয়ররা সবাই পিঠ চাপড়ে বলতেন, 'তোর বোলিং ভালো, চাইলে স্টেডিয়ামে গিয়ে অনুশীলন করতে পারিস।'
সাত ভাই এবং ছয় বোনের সংসারে সবচেয়ে ছোট রাজা। টেপ টেনিস ছিল তার কাছে 'প্রথম ভালোবাসা'। টেপ টেনিসে খেলতে খেলতেই তিনি পেয়ে যান স্বপ্নের সিড়ি। তার বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়ে এলাকার সিনিয়র ক্রিকেটাররা তার হাতে তুলে দেন ক্রিকেট বল।
ক্রিকেট বলেও তার শুরুটা হয় দারুণ। যদিও পরিবারের কারণে ক্রিকেট স্বপ্ন ফিঁকে ওঠে তার। কিন্তু ২০১৯ সালে বাবা হারানো রাজা ক্রিকেট ছাড়তে নারাজ ছিলেন। মাকে বুঝিয়ে সিলেটের এক একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান তিনি। এর কিছুদিন পর ঢাকা চলে আসেন ২২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার, ভর্তি হন মিরপুরের সিটি ক্লাবে।
সেখান থেকে নেট বোলার হিসেবে মিরপুর স্টেডিয়ামে সুযোগ মেলে রাজার। যেখানে হাই পারফরম্যান্স বিভাগের পেস বোলিং কোচ চম্পাকা রামানায়েকের নজরে পড়েন তিনি। পাশাপাশি ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স, সব মিলিয়ে স্বপ্নের টেস্ট দলে ডাক পেয়ে গেলেন রাজা।
জাতীয় দলে ডাক পাওয়া এই ক্রিকেটারের অনুপ্রেরণা টেপ টেনিস। তার ভাষায়, 'টেপ টেনিস খেলা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া। এলাকায় টেপ টেনিস খেলার পর একটা ক্রিকেট বলের টুর্নামেন্ট হয়েছিল। আমি সেখানে খেলতে যাই। তখন বড় ভাইরা বোলিং দেখে বলছিলেন, 'তোর বোলিং ভালো হচ্ছে, তুই চাইলে স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট অনুশীলন করতে পারিস।' তো আমি বড় ভাইদের কথা শুনে অনুশীলনে গেলাম। অনুশীলনে গিয়ে আমার মনে হলো যে, ইনশা আল্লাহ আমি পারব। এভাবেই আসলে আমার ক্রিকেটে আসা।'
পেসার হয়ে ওঠার কারণ জানাতে গিয়ে রাজা বলেন, 'আসলে চ্যালেঞ্জ নেওয়া পছন্দ করি। আমাদের বড় ভাইদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া। আমাদের সিলেটে যেমন রাহি ভাই, এবাদত ভাই, খালেদ ভাইদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। এই থেকেই আসলে পেস বোলার হওয়ার একটা উৎসাহ জেগেছে।'
পেসাররা শুরুরে গতিতে শেষ করতে পারেন না। রাজার দাবি, শেষ আরও গতি বাড়ে তার। ১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা এই পেসার বলেন, 'টেস্ট খেলা আমি উপভোগ করি। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম শ্রেণিতে ভালো করেছি। চারদিনের খেলায় প্রতিদিন কয়েকটা স্পেলে বোলিং করতে পারি। দিনের শুরুতে যে পেসে বোলিং করি, দিনের শেষে তার চেয়ে একটু বেশি পেসে বল করতে পারি।'