চুপসে যাচ্ছে চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প
১৯৮৪ সাল থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জুতা তৈরির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কবির হোসেন (৫০)। ৫ জন শ্রমিক আর প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে ২ লাখ টাকা নিয়ে চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় গড়ে তোলেন জেরিন সুজ নামে ছোট্ট একটি পাদুকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। আস্তে আস্তে তার প্রতিষ্ঠানটি বড় হয়, একসময় মাসে ৩-৪ লাখ টাকার পর্যন্ত জুতা বিক্রি করতেন কবির হোসেন।
কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে ভারত ও চায়না থেকে আমদানিকৃত জুতায় বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিল তার।
কিন্তু করোনার ধাক্কায় একেবারে ধসে যায় কবির হোসেনের পড়তি ব্যবসা। তার মতো আরও প্রায় একশো জুতা প্রস্তুতকারী বিদেশি প্রতিযোগীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে এবং চূড়ান্তভাবে মহামারির ধাক্কায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
কবির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চায়না জুতায় বাজার সয়লাবের কারণে আমরা হাতে তৈরি করা দেশি উৎপাদনকারী এমনিতেই ব্যাপক মন্দায় ছিলাম। তারপর করোনা আসার কারণে লকডাউনে কারখানা বন্ধ, দোকান ভাড়া, কারিগরের মাসিক বেতন, অপরদিকে বকেয়া টাকা আটকে পড়া এবং জুতার অর্ডার ব্যাপক কমে যাওয়ায় আর টিকে থাকতে পারছিলাম না ব্যবসায়। তাই প্রথম লকডাউনের পরেই কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।'
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, তিনি ১৯৯২ সাল থেকে চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। চীনা জুতার প্রভাবে ২০১৪ সালে তার জুতার কারখানাটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমার কারখানায় একসময় প্রায় ৭০ জন শ্রমিক কাজ করত, বছরে ৫০ লাখ টাকার টার্নওভার ছিল। কিন্ত ভারত ও চায়না মালের কারণে আমার দেশীয় পাদুকা কারখানাটি ধসে যায়। ফলে কোনোমতে আর পোষাতে না পেরে সর্বশেষ আমি আমার কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হই।'
চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা মালিক সমিতির তথ্য অনুসারে, একসময় বন্দরনগরীতে প্রায় ৬০০ ক্ষুদ্র পাদুকা কারখানা ছিল। ২০১২ সাল থেকে করোনার আগ পর্যন্ত চীনা জুতার বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর করোনার প্রভাবে বন্ধ হয়ে যায় ১০০টি কারখানা। এখন মাত্র ৩৫০ কারখানা চালু আছে।
সমিতির তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের আগে এ শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫০০ কোটি টাকা। এখন বছরে ২০০ কোটি টাকার মতো বিক্রি হয়।
গত দেড় বছরে করোনায় এ খাতে লোকসান হয়েছে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার। মহামারির প্রভাবে বিক্রি ও কার্যাদেশ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়াও এ খাতের অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী কারখানা বন্ধের কারণে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
এক সময় বছরে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ জুতা উৎপাদন হতো এও শিল্পে। করোনাকালে গত বছর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটির মতো।
স্বাধীনতার আগ থেকেই চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় কয়েকটি কারখানায় চামড়ার জুতা তৈরি হতো। কিন্ত ১৯৯০-এর দশকে এই শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ী, অভয় মিত্র ঘাট, জলসা মার্কেট ও নালাপাড়ায় সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে এই ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প। এই কারখানাগুলোতে প্রস্তুতকৃত জুতায় ৯০ শতাংশ রেকসিন ও ১০ শতাংশ চামড়া ব্যবহৃত হয়।
অনেক কারখানা মালিকই এখন টিকে থাকার জন্য লড়াই করছেন। দিপালী সুজ কারখানার মালিক আজহার উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'একসময় আমি সপ্তাহে ১৫০ ডজন জুতা তৈরি করতে পারতাম। কিন্ত এখন সপ্তাহে ৫০ ডজন জুতারও অর্ডার পাই না।'
জুতা কারখানার শ্রমিক বেলায়েত হোসেন বলেন, 'একটা সময় কাজের চাপে ঠিকমতো দুপুরে খাবারেরও সময় পাওয়া যেত না, এখন করোনা ও বিদেশি জুতার সয়লাবে আগের মতো কাজের চাপ নেই।'
চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মোসলেহ উদ্দিন খাঁন বলেন, 'উদ্যোক্তাদের কেউই সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ঋণ পাননি। অনেকেই পুঁজির সংকটে ব্যবসায় ফিরতে পারছেন না। যেসব কারখানা আবার নতুন করে ব্যবসা করছে, তারাও সংকটে রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে বিদেশি জুতার আমদানিতে যাতে পর্যাপ্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। বিদেশ থেকে আমাদের কাঁচামাল আদমানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে যেন ১০ শতাংশ করা হয়। এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে হাতে জুতা তৈরি করার পরিবর্তে দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কম খরচে বেশি উৎপাদন করতে পারে সেজন্য অত্যাধুনিক মেশিনারিজের স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি।'
সংগঠনটির সভাপতি মনজুর খাঁন টিবিএসকে বলেন, '২০০২ সাল থেকে আমরা বিদেশি জুতার বাজার দখলের ব্যাপারে বহু আন্দোলন করেছি, সরকার কর্ণপাত করছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমাদের অত্যাধুনিক মেশিনারিজ দেওয়া হোক, বিদেশি জুতার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া হোক, আমাদের এই উন্নতমানের পণ্যের দেশে-বিদেশে মার্কেটিং করা হোক এবং উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদি জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হোক।'
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পাদুকা খাতকে প্রণোদনার ঋণ সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু এ খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না, এ আশঙ্কায় ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'এছাড়াও এই ক্ষুদ্র শিল্পখাত টিকিয়ে রাখতে বিদেশ থেকে কিছু অত্যাধুনিক মেশিনারিজ সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছি। কালুহাটি, ভৈরব ও চট্টগ্রামে এই মেশিনারিজ স্থাপন করা হবে। তা না হলে এই স্বল্প পুঁজির ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে এসব দামি মেশিনারিজ কিনে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়।'