ডেল্টা প্ল্যানে বিনিয়োগ বাড়ছে, তহবিল গঠনে সোমবার বৈঠকে বসছে সরকার
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু সহনশীলতা তৈরির লক্ষ্যে ১০০ বছরের বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের বিভিন্ন প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে সরকার।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত সংস্কারও চলছে। কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি ডেল্টা গভর্নেন্স কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে যখন মহাপরিকল্পনাটি শুরু হয়; সে সময় ব্যাপক উন্নয়নের এ পরিকল্পনার আওতাধীন প্রকল্পগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির মাত্র দশমিক ৬৬ শতাংশ।এছাড়া, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে এ উদ্দেশ্যে সরকারের বিনিয়োগ ছিল মোট জাতীয় উৎপাদনের যথাক্রমে দশমিক ৯০ এবং ৮৯ শতাংশ।
তবে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) একটি প্রতিবেদন সূত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকার ডেল্টা প্ল্যানের অধীন প্রকল্পগুলির জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে জিডিপির ১.১৩ শতাংশ বা ৩৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা আলাদা করে রেখেছে।
জিইডি'র প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বরাদ্দ সরকারের জিডিপির ১.৩০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম।
পরিকল্পনা কমিশনের অধীন বিভাগটির পরামর্শ, ডেল্টা প্ল্যানের জন্য বার্ষিক বিনিয়োগ ঘাটতি মেটাতে ২০২৫ সালের মধ্যে বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে জিডিপির ২.৫ শতাংশে উন্নীত করা দরকার।
জিইডির সদস্য (সচিব) কাউসার আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডেল্টা প্ল্যানের প্রাথমিক বছরগুলিতে, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা একটু বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে থাকলেও এখন ধীরে ধীরে বিনিয়োগ বাড়ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাকি সময়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।"
জিইডি'র প্রতিবেদনে- পরিকল্পনার সাথে যুক্ত মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলির জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ সোমবার (৩১ জানুয়ারি) ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকে মেগা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই পরিবেশ অর্জনের লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে ডেল্টা প্ল্যান অনুমোদন দেয়, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করারও লক্ষ্য রয়েছে।
ডেল্টা প্ল্যানের প্রথম পর্যায়ে, ৮০টি প্রকল্প ২০৩১ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পগুলি অন্যান্য প্রকল্পের সাথে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ; চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ডেল্টা প্ল্যান সম্পর্কিত ৩৭১টি প্রকল্প রয়েছে।
ডেল্টা তহবিল:
ইতিমধ্যেই দ্বৈত-পদক্ষেপ পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেল্টা ফান্ডের নীতিগত ব্রিফ।
প্রথমে সরকারি, বেসরকারি, দেশি ও বিদেশি সব বিনিয়োগ এই তহবিলে বিবেচনা করা হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হবে। বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে এটি অব্যাহত থাকবে। নাহলে দ্বিতীয় ধাপে আইনি কাঠামো তৈরি করে আলাদা তহবিল তৈরি করা হবে।
ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন:
ডেল্টা প্ল্যানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নেদারল্যান্ডস এবং জিইডি ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় দুই দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এ সম্মেলনের সহ-স্পন্সর করতে সম্মত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে ডেল্টা প্ল্যানের কৌশল এবং অগ্রাধিকারগুলি তুলে ধরা হবে।
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প:
যমুনা নদী অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন প্রকল্প- ডেল্টা প্ল্যানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রস্তাবিত প্রকল্পটি রংপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটার এলাকায় যমুনা নদীর নাব্যতা বাড়াবে। এছাড়া, নদী শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এলাকাটিকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, প্রকল্পটি যদি ১৩.৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে বাস্তবায়িত হয়; তবে এটি ২০৪৪ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ৩৬২ বিলিয়ন ডলারের অবদান যোগ করবে। এই অবদানের পরিমাণ বাংলাদেশের জিডিপির আকারের চেয়েও বেশি।
ইতোমধ্যে এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতেও রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ডেল্টা প্ল্যানের অধীনে আরেকটি অগ্রাধিকার প্রকল্প হলো- "চলন বিলের পুনরুজ্জীবন ও পুনরুদ্ধার"। নেদারল্যান্ড সরকার চলন বিলের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য ৫ কোটি ইউরো সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। জল ব্যবস্থাপনা, কৃষি, বন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র এবং মৎস্য সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন রয়েছে এ পরিকল্পনায়।
এছাড়া "ঢাকা রিভার ইকোলজিক্যাল রিস্টোরেশন প্রকল্পে" বিশ্বব্যাংক ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরের আশপাশের নদী ও খালে পানির প্রবাহ বাড়ানো হবে। ঢাকা শহরের আশপাশে বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা হবে।
ডেল্টা প্ল্যানে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য ভূপৃষ্ঠের পানির জলাধার নির্মাণ এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কৌশল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নাব্যতা বাড়াতে বিভিন্ন নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তেমনই একটি নদী- বাঙ্গালী। ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায় যমুনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে করতোয়া, বড়াল, ফুলজোর এবং হুরা সাগর নদী হয়ে আবার সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বাঙ্গালী নদীতে কয়েকটি ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। এটি একটি বড় জলাধার তৈরি করবে, যেখান থেকে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় পানি সরবরাহ করা যাবে।
একইভাবে, তিস্তা ব্যারাজ থেকে তিস্তা-যমুনা সঙ্গম পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ১০১ কিলোমিটার এলাকা খনন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে জলাধার হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত ২৮৩ কিলোমিটার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং করে বর্ষা শেষে পানি ধরে রাখার কৌশলও গ্রহণ করা হয়েছে।
ডেল্টা প্ল্যানের প্রথম ধাপে গৃহীত ৮০টি প্রকল্পের মধ্যে ৩০টি বাস্তবায়ন করবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৪টি আর পাঁচটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি মন্ত্রণালয়।