'জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে কৃষিতে অবশ্যই হাইব্রিড, জিএমও জাতের দরকার রয়েছে'
বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপ চর পাতিলার প্রায় সব বাসিন্দা মাছ ধরার সাথে জড়িত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধন্য এ দ্বীপের চারপাশ ঘিরে সমুদ্র, দিনে দুবার জোয়ারে ধুয়ে যায় তীর।
চর পাতিলার বাসিন্দা বাদশাহ মিয়ার আছে মাছের ব্যবসা। আর আছে প্রায় এক ডজন গরু, অন্য শত শত গবাদি পশুর সাথে সেগুলো দ্বীপের সমভূমিতে চড়ে ঘাস খায়।
কিন্তু বাদশাহ মিয়ার শীর্ণ স্বাস্থ্যের গরুগুলি তেমন দুধ দিতে পারে না– দিনে বড়জোর দুই লিটার, এপর্যন্তই। দ্বীপের অন্য হাজার হাজার গরুর দৈনিক দুধ উৎপাদনের ক্ষমতাও একই।
একই চিত্র কমবেশি সারা দেশজুড়েই দেখা যায়; যেখানে গবাদি পশুপ্রতি দুধ ও মাংসের উৎপাদন খুবই কম।
এজন্যই দেশে আড়াই কোটি গরু থাকার পরও বিদেশ থেকে দুধ ও মাংস আমদানি করছে বাংলাদেশ। মাংসের মধ্যে প্রতিবেশী ভারত থেকে মূলত আসছে মহিষের মাংস।
এবার যদি একটু নিউজিল্যান্ডের কথা বিবেচনায় নেন, তাহলে দেখবেন চমকপ্রদ এক চিত্র। দেশটিতে গরুর সংখ্যা বাংলাদেশের মাত্র এক-চতুর্থাংশ বা ৬৩ লাখ হলেও- দেশটি দুধ রপ্তানিতে বিশ্ব বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কেবল পশুসম্পদের উৎপাদনশীলতায় নয়, এমন জীর্ণতায় ভুগছে দেশের কৃষি খাতও– এমনটাই মনে করেন এসিআই এগ্রি বিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী। বাংলাদেশের কৃষি আর এর ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে এক অর্থপূর্ণ আলোচনা করেন তিনি।
দেশের কৃষি ব্যবসায় একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আনসারী গত ৪১ বছর ধরে এ পেশায় রয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ কৃষির প্রায় সকল খাত- পশুসম্পদ, ধান, সবজি ও ভূট্টা- ইত্যাদি উৎপাদনে ঈর্ষনীয় সফলতা অর্জন করলেও সামনে এখন অজস্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বীজ উৎপাদন এবং প্রজননের দিকে মনোনিবেশ করার সাথে সাথে বাংলাদেশে আরও আবহাওয়া সহনশীল ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তনেও সাফল্য উপভোগ পেয়েছে- সেকথাও উল্লেখ করেন।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ উৎপাদনশীলতার দিক থেকে অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তরুণ প্রজন্ম কৃষিকাজে প্রবেশে নারাজ। খাতটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চললেও আনসারী উল্লেখ করেন, তারপরও আমাদের বছরে প্রায় ১ কোটি টন খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, "আমাদের দেশে এখন যারা কৃষিকাজ করছে তাদের অধিকাংশের বয়স ৫০- এর উপরে। নতুন প্রজন্ম কৃষিতে আসছে না। ২০০০ সালে আমাদের কৃষি শ্রমিক ছিল ৬০ শতাংশ (মোট জনসংখ্যার), যা এখন ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ২০৩০ সালে এটি ২৭ শতাংশে নেমে যাবে। এর কারণ হলো- গার্মেন্টস খাতে বিপুল কর্মসংস্থান, পরিষেবা শিল্প, অন্যান্য ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে কৃষির বাইরে কর্মসংস্থান এবং বিদেশে বিপুল সংখ্যক শ্রম অভিবাসন।"
"এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত ৫-৬ বছরে মাটির তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে কৃষি জমি কমছে"- যোগ করেন আনসারী। ১৯৮১ সালে বহুজাতিক কোম্পানি সিবা-গাইগি'তে (এখন- সিনজেনটা) কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক স্থানীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ ব্যবস্থাপক পদগুলোয় দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি আরও বলেছেন, অন্য দেশগুলোর মতো অধিক উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তনে জোর গুরুত্ব দানে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ, যা উৎপাদনকে ব্যাহত করছে।
হাইব্রিডের কোনো বিকল্প নেই:
কৃষি শ্রমিক সংকট, বিরুপ জলবায়ুর প্রভাব এবং নিম্ন উৎপাদনশীলতা- এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মিলে ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং পরিবেশ বিজ্ঞান ও বাস্তুবিদ্যায় পিএইচডিধারী ড. আনসারী।
তিনি বলেন, "কৃষি খাতের এ অবস্থার প্রভাবটি অনেক বড় হিসাবেই আমাদের সামনে আসবে। আমাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হয় আমদানি অথবা উৎপাদন বাড়াতে হবে।" এভাবে তিনি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে কৃষিতে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি এবং এ খাতকে আরও লাভজনক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। নাহলে বর্তমান পদ্ধতির কৃষি যথেষ্ট হবে না।
কৃষি খাতে মুনাফা বাড়লে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও আগ্রহ বাড়বে। এর জন্য কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে তা উল্লেখ করে আনসারী বলেন, আগামীদিনের চ্যালেঞ্জগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে, প্রথমেই আমাদের আরও উচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করা উচিত। এরপর তা মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
সব ধরনের ফসলের জাত সংযোগ ও গবাদিপশুর প্রজননের বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, "প্রজননে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এই কাজ সরকারের হাতে। বেসরকারি খাত তেমন কিছু করতে পারে না।
"আমাদের এক কোটি টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। কারণ ৭০-৮০ শতাংশ জমি ধান চাষে ব্যবহৃত হয়। ধানের ফলন হেক্টর প্রতি চার টন, তবে এটিকে ৭-৮ টন পর্যন্ত উন্নীত করতে পারলে ৪০ শতাংশের মতো জমি রিলিজ (ধান চাষ মুক্ত) হবে। তখন আমরা অন্যান্য ফসল চাষও বাড়াতে পারব আর আমদানিও কমে যাবে।"
কিন্তু কীভাবে ফলন বাড়ানো যায়? আনসারী জানান, ধানের হাইব্রিড জাতগুলোর সাফল্যের দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যেই মিলেছে।
নতুন উদ্ভাবিত বিআর-৬৯ জাত সাত টন ফলন দিতে পারে। আবার বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আট টন ফলন দিতে পারে এমন একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে।
আনসারী বলেছেন, "অনেকেই এখন নতুন হাইব্রিড তৈরি করছে, তবে এ বিষয়ে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন।"
"সম্প্রতি আলুতে সরকার ছাড় দিলো। ফলে তিন বছরে ৪০টির মতো নতুন জাতের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এখনকার আলু দিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, স্ট্রার্চ হচ্ছে। আগের আলুতে হতো না।"
হাইব্রিড জাতের ভালো ফলন বিশ্বের অনেক জায়গায় স্পষ্ট দেখা যায়। উচ্চ ফলনশীল জাতের ক্ষেত্রে ইউরোপের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রীর সাথে নেদারল্যান্ড সফরে গিয়ে আমরা দেখেছি, তারা প্রতি হেক্টর জমিতে এক হাজার টন টমেটো উৎপাদন করে। কিন্তু আমাদের দেশে তা শীতকালে মাত্র ২৫ টন এবং গ্রীষ্মে ৬০ টন। আমাদের দেশে একটি গাভি ২-৩ লিটার দুধ দেয় যেখানে নিউজিল্যান্ডের একটি গাভি ৩০-৪০ লিটার দুধ দেয়। আমাদের এই ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করতে হবে কারণ আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।"
বিভিন্ন জাত ব্যবহারের বিষয়গুলি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে সম্মতির বিষয়গুলি স্পষ্ট করতে হবে। হাইব্রিড ছাড়াও, ফসল সংগ্রহ পরবর্তীতে পর্যায়েও বিনিয়োগের প্রয়োজন, যা দেশে খুব কমই রয়েছে।
এর পরে, ফসল প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণসহ সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আনসারী বলেন, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে তিনি এ খাতে এসেছেন। আর সেজন্য বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন ছিল, কারণ সারা বিশ্বে বেসরকারি খাতের হাতেই সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ছিল।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা:
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৮-২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জাত-বৈচিত্র্য এবং প্রজনন প্রযুক্তিতে ১৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বেড়েছে ১০৩ শতাংশ। তবে এই অর্জনের পেছনে সরকারি ও বেসরকারি খাতেরই অবদান রয়েছে। তবে আনসারী জানান, অন্যান্য দেশের তুলনায় এদেশে বেসরকারি খাতেরই অবদান বেশ কম।
মাত্র ৬০ লাখ গবাদিপশু নিয়ে নিউজিল্যান্ড বিশ্বব্যাপী দুধের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যেখানে আড়াই কোটি গরু থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুধের অন্যতম বড় আমদানিকারক। তিনি বলেন, আমাদের স্বল্প-বেসরকারিকরণের কারণেই এমনটা হয়েছে।
"ভারতের গোদরেজ পুনেতে একটি ক্যাটল ফার্ম চালাচ্ছে। তারা দৈনিক গরু প্রতি ৩৯ লিটার করে দুধ পায়। যেখানে আমরা ৪-৬ লিটারের বেশি পাই না। গোদরেজের এই মডেল আমাদের দেশে হলে আর দুধ আমদানি করতে হবে না।"
আমাদের দেশে নীতি দিয়ে আটকে দেয়ার কারণে ব্রিড হচ্ছে না। মাংসের ক্ষেত্রে একারণে আমরা ব্রাহমা ও বেলজিয়াম ব্লু জাতের গরু আমদানি করতে পারি না। অথচ এই
গরুগুলো দুই বছরে আড়াই-তিন টন মাংস দেয়। সরকার নীতি-সহায়তা দিলে প্রাইভেট সেক্টর এগিয়ে আসবে"- যোগ করেন আনসারী।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতের কারণে দেশে উন্নত বীজ আসছে। প্রায় ৯০ শতাংশ বীজ বেসরকারি খাত সরবরাহ করে। গবাদি পশুর জন্য সরকার ৩০-৩৫ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে। পোল্ট্রির ক্ষেত্রে, প্রায় ১০০ শতাংশই বেসরকারি খাত করে। এছাড়া, মাছের ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে ব্যক্তি পর্যায়েই বেশি ব্রিড আমদানি হচ্ছে।
গবেষণা ও প্রযুক্তি:
বৈশ্বিক কৃষিখাতে আরেকটি বিপ্লব হলো- জেনেটিকালি-মডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) ফসলের প্রবর্তন।
জিন প্রকৌশলে পরিবর্তিত জাত বিটি বেগুন যখন প্রথম বাংলাদেশের বাংলাদেশের বাজারে আনা হয়, তখন ক্রেতারা প্রথমে এটি গ্রহণ করতে চায়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে তারাও তা মেনে নিতে শুরু করেছে। উচ্চ ফলনশীল জাতটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বলেও প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষণা এবং প্রযুক্তি এই বিষয়ে চাবিকাঠি ছিল উল্লেখ করে আনসারী বলেছেন, জিএমও গবেষণা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং এর উপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া উচিত।
"কেউ বিটি বেগুনের ক্ষতিকর প্রভাব দেখাতে পারেনি, এমনকি একইভাবে তৈরি ভুট্টাতেও দেখাতে পারেনি"- তিনি বলেন।
জিএমও ফসলের বিষয়ে আনসারী বলেন, "বর্তমান গবেষণাগুলো থেকে জানা যায়, আপনি যে ফল খাবেন তাতে অতিরিক্ত খনিজ উপাদান থাকবে। ফলস্বরূপ, এর পুষ্টিগুণও প্রাকৃতিক ভিটামিনের তুলনায় বেশি হবে।"
"টেকসই চাষ পদ্ধতি তৈরি করা হচ্ছে। ফলন বাড়াতে এবং ফসল দ্রুত পাকানোর পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কম রাসায়নিক ব্যবহার করে ফলন বাড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। মাছ, মুরগি ও মাংসের ক্ষেত্রে কম সময়ে অধিক ফলনশীল করে তোলার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হচ্ছে।"
"গবেষণার ভিত্তিতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি মেনে নিতে সরকার ও দেশের সকল সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে"- বলেই মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ এ কৃষি বিশেষজ্ঞ।