চাহিদার ১২ শতাংশ ভোজ্যতেল উৎপাদন করবে বসুন্ধরার প্লান্ট
- পুরো প্রকল্পে খরচ হবে ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা টাকা
- ব্যাংক ঋণের ৬৫ শতাংশ দিবে অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক
- আমদানি যন্ত্রপাতির পরিমাণ ৫৮৯.২৭ কোটি টাকা
- দেশে সয়াবিন তেলের চাহিদা বছরে ২০ লাখ টন, উৎপাদন ৩ লাখ টন
- জনপ্রতি সয়াবিনের ব্যবহার ৯.৯ লিটার
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা (সীড ক্রাশিং প্লান্ট) নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রকল্প ভোজ্য তেল উৎপাদন করেতে যাচ্ছে। এই প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন উৎপাদন হবে ১ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল।
বসুন্ধরা এই প্রকল্পটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর গ্রামে। যাতে খরচ হবে ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ মুলধন সংগ্রহ করা হবে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। বসুন্ধরার নগদ ক্যাশ হিসেবে যোগান দিবে হবে বাকি ৩৫ শতাংশ।
প্রকল্পটি করতে বসুন্ধরা পিরোজপুর গ্রামে ১৪৭৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ জমি নিয়েছে তারা, যাতে তাদের ব্যয় হবে ১১৮ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া অবকাঠামোর আওতায় খরচ হবে ২০৬ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
সম্প্রতি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ও রাষ্ট্রায়ত্ত দুই ব্যাংকের মধ্যকার 'সিন্ডিকেট প্রজেক্ট লোন' স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সিন্ডিকেশন ব্যবস্থার আওতায় মোট বিনিয়োগ ব্যয়ের বিপরীতে ৬৬৫ দশমিক ২৭ কোটি টাকা প্রকল্প ঋণ মঞ্জুরিতে লীড এ্যারেঞ্জার ও এজেন্ট ব্যাংকের ভুমিকা পালন করছে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে আরও অর্থায়ন করছে রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক। তারা অর্থায়ন করবে ৩১৫ দশমিক ২৭ কোটি টাকা।
এদিকে সীড ক্রাশিং প্লান্ট প্রকল্পে সয়াবিন সীড ক্রাশিং প্রতিদিন ৫ হাজার মে. টন উৎপাদন করলে ২৯৬ দিনে মোট উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ মে. টন। এছাড়া সানফ্লাওয়ার সীড থেকে ক্রুড এডিবল ওয়েল প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ মে. টন উৎপাদন করলে বছরে মোট উৎপাদন করা যাবে ১০ হাজার ৮০০ মে. টন।
সীড ক্রাশিং প্লান্ট প্রকল্পের বাস্তবায়নের চিত্র থেকে দেখা গেছে, ভোজ্যতেল উৎপাদানে বাইরে থেকে যন্ত্রপাতি আনতে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার মাধ্যমে ৪০৮ দশমিক ৪ কোটি টাকার এবং ইসলামী ব্যাংকের হেড অফিস কমপ্লেক্স ভবন শাখায় ১৭৬ কোটি টাকার 'ইউসেন্স পেয়েবল অ্যাট সাইট' খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের আদমানী যন্ত্রপাতি প্রকল্পস্থানে আনা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় আমদানি যন্ত্রপাতির পরিমাণ হবে ৫৮৯.২৭ কোটি টাকা। এছাড়া দেশীয় যন্ত্রপাতির পরিমাণ হবে ২৪.১১ কোটি টাকা।
প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান যার শেয়ার পরিমাণ ৭৪.৮৯ শতাংশ, পরিচালক ময়নাল হোসেন চৌধুরির ০.১১ শতাংশ। এছাড়া শেয়ার হোল্ডার রয়েছেন সাদাত সোবহান, সোনিয়া ফেরদৌসি সোবহান ও আহমেদ ইব্রাহিম সোবহান। তাদের শেয়ারের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে ৯, ৮ ও ৮ শতাংশ।
এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস-উল ইসলাম বলেন, "বসুন্ধরা গ্রুপে কোনো ধরনের খেলাপি ঋণ নেই। কখনো ঋণ পুনঃতফসিলও করতে হয়নি এবং সুদ মওকুফেরও ইতিহাস নেই। দেশের বড় বড় প্রকল্প নির্মাণে সিন্ডিকেশন ঋণের ভুমিকা অনেক। কারণ একক গ্রাহকের ঋণ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করা আছে তাই সিন্ডিকেশন ঋণ প্রদাণ করতে হয়। এই ঋণের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা রাখছে।"
তিনি আরও বলেন, "বসুন্ধরার মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের (সীড ক্রাশিং প্লান্ট) ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে বিরাট ভুমিকা রাখবে এর ফলে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে সাত হাজার মে. টন সীড ক্রাশিং করতে পারবে।"
শামস-উল ইসলাম বলেন, "অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক লিমিটেড বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রকল্পে ১৯৯৩ সাল থেকে অর্থায়ন করে আসছে। এই গ্রুপ নিয়মিত ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে অনেকগুলো কোম্পানি/প্রকল্পের ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছে এবং যে ঋণ চলমান রয়েছে তার সবগুলোই নিয়মিত রয়েছে।"
দুই ব্যাংকের সঙ্গে সিন্ডিকেট প্রজেক্ট লোন ফ্যাসিলিটি এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, "উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ইউনিক। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সরকার যেসব নীতি সুবিধা দিচ্ছে তা কাজে লাগিয়ে বসুন্ধরা উৎপাদনমূখী শিল্প তৈরি করে মানুষের আস্থা তৈরি করবে। আমারা কমিটেড এদেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করবো।"
এ বিষয়ে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস এর জেনারেল মেনেজার রেদওয়ানুর রহমান বলেন, "সয়াবিনের ক্রডের জন্য আমাদের দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে নির্ভর করতে হয় আমদানির উপরে। আমাদের এ প্রকল্পটা দেশের অর্থনীতি ও মার্কেটের জন্য সুসংবাদ। এর মাধ্যমে দুই হাজার মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান হবে।"
এছাড়া প্রথমবারের মতো বসুন্ধরা গ্রুপ স্বর্ণ পরিশোধনাগার কারখানা নির্মাণের অনুমতি পেয়েছে। বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি লিমিটেড নামের এই পরিশোধনাগার নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ তারা নিবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে বাকি ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বসুন্ধরা গ্রুপের নিজস্ব।
যদিও বসুন্ধরাকে পরিশোধনাগার নির্মাণে ঋণ দিতে ইতোমধ্যে পাঁচটি ব্যাংক মিলে সিন্ডিকেট বা জোট করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতির অপেক্ষায় ছিলেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো একক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমার বাহিরে যাওয়ায় এ ঋণ পেতে আরও অধিক বেসরকারি ব্যাংককে যুক্ত করতে বলা হয়েছে। এই সিন্ডিকেট ঋণেরও নেতৃত্বে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক।
বসুন্ধরার এই কারখানা চালু হলে স্বর্ণ পরিশোধনের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির পর তা কারখানাটিতে পরিশোধনের মাধ্যমে স্বর্ণের বার ও কয়েন উৎপাদন করা হবে। সেগুলো রপ্তানির পাশাপাশি দেশেও অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। পাশাপাশি রপ্তানিও হবে।
দেশীয় সয়াবিনের বাজার
আমদানি করেই দেশে সয়াবিন তেল বাজারজাত হচ্ছে নব্বইয়ের দশক থেকে। বিদেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে দেশে শুধু পরিশোধন করা হতো। ২০০৭ সালে দেশে প্রথম সয়াবিন মাড়াইয়ের কারখানা করে সিটি গ্রুপ।
এরপর ২০১১ সালে বাজারে আসে মেঘনা গ্রুপ। পরবর্তীতে বসুন্ধরা গ্রুপ যুক্ত হয় সয়াবিন মাড়াইয়ে। বর্তমানে মেঘনা ও সিটি গ্রুপ আলাদা চারটি প্লান্টে দৈনিক যথাক্রমে ৭০০০ ও ৭৫০০ মেট্রিক টন সয়াবিন মাড়াই করে।
বসুন্ধরা নতুন প্রকল্পে ৭৫০০ মে টন সীড ক্রাশিং করবে। এছাড়া বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে প্রায় ১৫০০ মে. টন।
এই তিন গ্রুপের পাঁচটি কারখানা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্লোব এডিবল অয়েল নামে ভোজ্যতেল কারখানা চালু করেছে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি।
সব মিলিয়ে দেশের কারখানাগুলো বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন বীজ মাড়াই করে। আর এ মাড়াই থেকে বছরে ৩ লাখ টন সয়াবিন উৎপাদন তেল উৎপাদন হয় বলে উঠে এসেছে লাইট ক্যাসেলের এক গবেষণায়।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২৩ লাখ টন সয়াবিন তেলের চাহিদার বিপরীতে ২০ লাখ টনই আমদানি করা অপরিশোধিত তেল থেকে হচ্ছে বলে বলছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের মোট চাহিদার তুলনায় এটি খুব সামান্য।
সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ভোজ্য তেল তীরের বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ মেট্রিক টন তেল বাজারজাত করা হয়।"