এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ভিন্ন নামে রপ্তানিতে ভর্তুকি, প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে বিদ্যমান নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি ভিন্ন নামে অব্যাহত রাখবে সরকার। এছাড়া, রপ্তানিখাতকে বাড়তি শক্তি যোগাতে মার্চেন্ট ট্রেড ও প্রতিবাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করবে। পাশাপাশি অগ্রাধিকার রপ্তানি পণ্যের ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন ইস্যুর ক্ষমতা রপ্তানিকারকদের হাতে ছেড়ে দেবে সরকার।
রোববার (২৭ মার্চ) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা 'রপ্তানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪'- এ এসব নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ব্রান্ড তৈরি ও বিস্তৃতি ঘটাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জোট- মার্কাসুরভুক্ত দেশগুলোতে ওয়্যারহাউজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেবে সরকার।
২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বেসরকারিখাতের সমন্বয়ে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
রপ্তানি আদেশে, ২০২৪ সাল নাগাদ দেশের রপ্তানি আয় ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা দেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে- অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা হারানোর পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিভিন্ন নীতির কারণে রপ্তানিকারকদের দেওয়া নগদ সহায়তা ও বিভিন্ন ধরণের ভর্তুকি দেওয়া যাবে না বলে রপ্তানি নীতি আদেশে উল্লেখ করা হয়।
এমনকী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে 'এভরিথিং বাট আর্মস স্কিমে'র আওতায় সুবিধা সীমিত হয়ে আসবে। এর ফলে গড় শুল্ক ১০% বৃদ্ধি পাবে, যা রপ্তানি প্রতিযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও উল্লেখ রয়েছে।
'প্রেফারেন্স ইরোশন, কঠোর রুলস অব অরিজিন প্রতিপালন, ডব্লিউটিও'র বিভিন্ন চুক্তির আওতায় দেওয়া স্পেশাল ও ডিফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট সীমিত হয়ে আসা, নোটিফিকেশন সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা, কঠোর কমপ্লায়েন্স ও স্ট্যান্ডার্ড প্রতিপালন, সরকার কর্তৃক রপ্তানিখাতে আর্থিক ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ, শ্রম অধিকার সুরক্ষা বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা আরোপিত হবে।'
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে প্রদত্ত রপ্তানি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও অন্যান্য প্রণোদনাগুলোকে ডব্লিউটিও সমর্থিত নীতি সুবিধার আওতায় রুপান্তরের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলেও রপ্তানি নীতি আদেশে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত, চীন ও ভিয়েতনামও নানান নামে রপ্তানিখাতকে সহায়তা করে থাকে।
যেমন ভারত ঘোষিত 'মেক ইন ইন্ডিয়া' কর্মসূচির আওতায় স্থানীয়ভাবে ব্রান্ড প্রতিষ্ঠা, শিল্প আধুনিকায়ন, উৎপাদন ও পণ্য সংযোজনে সরকার আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
ভিয়েতনাম শিল্প ও দক্ষতা আধুনিকায়ন নামে অনেক আগে থেকেই আর্থিক সুবিধা চালু করেছে। সম্প্রতি ভিয়েতনাম এ ধরণের সুবিধা দেওয়া কমিয়েছে। চীনও প্রযুক্তি আধুনিকায়ন নামে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এলডিসি গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসার পর রপ্তানিকারকদের জন্য সুবিধা অব্যাহত রাখার একটি প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে বাংলাদেশকে এখনই গবেষণা শুরু করতে হবে।
তার সাথে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য (পিআরএল) ড. মোস্তফা আবিদ খান বিজনেস টিবিএসকে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কর্মসংস্থান নিরাপত্তা তহবিল বা শিল্প আধুনিকীকরণ তহবিল নামে হয়তো প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।
'বাংলাদেশ যদি শিল্প আধুনিকীকরণ নামে আর্থিক সহায়তা দিতে আইন বা নীতিমালা করে, সেখানে শুধু রপ্তানিখাত পাবে-একথা বলা যাবে না। তাহলে ডব্লিউটিও'র নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন হবে। সেক্ষেত্রে অন্য সকল শিল্পকেও দিতে হবে'- জানান এম এ রাজ্জাক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ রয়েছে ৭,৩৫০ কোটি টাকা, আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৬,৮২৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখার চেয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তার মন্তব্য, 'এফটিএ করে ভিয়েতনাম তাদের রপ্তানি বাজারে সক্ষমতা বাড়িয়েছে, আমাদেরও তাদেরকে পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত।'
এছাড়া ব্যবসায়ের ব্যয় কমানো (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) ও 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস'- এ গুরুত্ব দিতে হবে। এর সঙ্গে রপ্তানিকারকদের জন্য ম্যান মেড ফাইবারের পোশাক রপ্তানি সহজ করতে দীর্ঘমেয়াদী ও নির্ভরযোগ্য সহায়ক রাজস্ব নীতি হলে রপ্তানি বাড়বে বলেও মনে করছেন শহীদুল্লাহ আজিম।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত, অথবা নতুন আরেকটি রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে ঘোষিত এই নীতিমালাটি। রপ্তানি বাণিজ্য বহুমুখীকরণে মার্চেন্টিং ট্রেড ও প্রতিবাণিজ্য চালুর কথাও বলা হয়েছে এতে।
মার্চেন্টিং ট্রেড হলো, বাংলাদেশী মধ্যস্থতাকারীকে জড়িত করে এক ভিনদেশ থেকে অন্য ভিন দেশে পণ্য চালান বা রপ্তানির ব্যবস্থা।
আর প্রতিবাণিজ্য হলো- অর্থ বিনিময়ের বদলে বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যের মূল্য দ্বারা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য; কিংবা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য দ্বারা বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মূল্য সমন্বয় করার ব্যবস্থা।
বাংলাদেশে বর্তমানে মার্চেন্টিং ট্রেড ও প্রতিবাণিজ্য বিষয়ে কোন নীতিমালা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে বলে রপ্তানি নীতিতে বলা হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্চেন্টিং ট্রেড চালু হয়েছে জানিয়ে এমএ রাজ্জাক বলেন, বিশ্বব্যাপী এ ধরণের ব্যবসা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। 'বাংলাদেশেরও এক্ষেত্রে পলিসি করার প্রয়োজন আছে। একজন রপ্তানিকারক সিঙ্গাপুর থেকে একটি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে চাইলে- বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে সিঙ্গাপুরে পণ্য কেনা বাবদ কতো ডলার পাঠাতে দেবে এবং কেনা দামের চেয়ে রপ্তানিমূল্য কতো বেশি হতে হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জরুরি।'
রপ্তানি বাণিজ্যে লিড টাইম কমানো ও ব্যবসা পদ্ধতি সহজীকরণের জন্য অগ্রাধিকার রপ্তানি খাতগুলোতে যেসব মালিক সমিতির সক্ষমতা রয়েছে, তাদের অনুকূলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) জারির অনুমোদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে রপ্তানি নীতিতে।
একটি রপ্তানি অর্ডার পাওয়ার পর রপ্তানি পণ্য তৈরিতে কি পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োজন হবে- তা নির্ধারণ করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ দেওয়া হয় ইউডি'র মাধ্যমে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ইউডি ইস্যু করে। এতে বাড়তি সময়ক্ষেপণের অভিযোগ রয়েছে রপ্তানিকারকদের।
এ ধরণের অভিযোগের কারণে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য- তৈরি পোশাকের ইউডি ইস্যুর ক্ষমতা বিজিএমইএ'র হাতে ছেড়ে দিয়েছে সরকার। প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরাও কয়েক বছর ধরে একই ধরণের সুবিধা চেয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) এর সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, তৈরি পোশাকের অন্য বড় খাতগুলোর নিজস্ব সংগঠন ইউডি জারির করার ক্ষমতা পেলে তা ওইসব পণ্যের জন্য রপ্তানি বাড়ানো এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, 'আমাদের সংগঠন ইউডি ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে বহু আগে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলেও- এখনো তা কার্যকর হয়নি। এটি নিয়ে অনেকদিন ধরে এনবিআরের সঙ্গে লড়ছি।'
রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে তৈরি পোশাক শিল্পকে দেওয়া সরকারের বিভিন্ন সহায়তা যাতে সমানভাবে অন্যান্যখাতও পায়, সেজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রপ্তানি শিল্পের কাঁচামালের সহজলভ্যতা বজায় রাখা ও সরবরাহ চক্র নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে- খাত ও পণ্যভিত্তিক সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ স্থাপনের সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে রপ্তানি আদেশে।
গতবছর চীনে করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে লকডাউন শুরু হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী খাতগুলো কাঁচামাল সংকটে পড়ে। ওই সময়ই সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ স্থাপন কিংবা বিকল্প উৎস চিহ্নিত করা হবে বলে ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
রপ্তানি আদেশে, পণ্যের ডিজাইন, ফ্যাশন ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বিজিএমইএ'র ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি'র মতো বেসরকারিখাতে পণ্য/খাতভিত্তিক ডিজাইন, ফ্যাশন ও প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
অনলাইন প্লাটফর্ম ও ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেস তৈরিতে প্রযুক্তি, লজিস্টিকস ও অবকাঠামো উন্নয়নে রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা দেবে সরকার।
গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে দৃঢ় অবস্থান তৈরিতে ইন্টারমিডিয়েট গুডস উৎপাদন ও রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় নীতি সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি; এখাতে বিনিয়োগ আকৃষ্টে কর্মকৌশল প্রণয়ন করা এবং ম্যান মেড ফাইবারখাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সুনির্দিষ্ট করা হবে বলে উল্লেখ রয়েছে এতে।
ডিজিটাল পণ্য ও সেবার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে টেস্টিং ল্যাব প্রতিষ্ঠা এবং ওয়ারেন্টি ও স্যাম্পল পণ্য দ্রুত ও শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি ও রপ্তানির ব্যবস্থা করা হবে।
রপ্তানি আদেশে, হালকা প্রকৌশল (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং) শিল্পের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকারও রয়েছে।