একটু ত্রাণের জন্য হাহাকার
ত্রাণের প্যাকেট আছে ১২০টি। কিন্তু ত্রাণ নিতে জড়ো হয়েছেন হাজারও মানুষ। একপর্যায়ে ত্রাণের প্যাকেট নিয়ে হাতাহাতি ও হট্টগোল শুরু করেন বন্যার্তরা। তাদের থামাতে কঠোর হতে হয় পুলিশকে। ফলে ত্রাণ নিতে এসে লাঠিপেটার শিকার হন অনেকে।
গতকাল সকালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে ঘটে এ ঘটনা। বিদেশ সফর থেকে দেশে ফিরে শনিবারই প্রথম নিজ এলাকার বন্যা পরিস্থিতি দেখতে আসেন প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। কোম্পানীগঞ্জে এসে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমেরও উদ্বোধন করেন তিনি। মন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানেই ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
সেখানে ত্রাণ নিতে আসা মানুষজনের অভিযোগ, প্রায় ১০দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ পাননি তারা।
কেবল কোম্পানীগঞ্জ নয়, সিলেটের অন্যান্য বন্যা কবলিত এলাকায়ও ত্রাণের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। খাবারের অভাবে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েও চলে আসছেন অনেকে। সবচেয়ে বেশি সঙ্কট দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির। যদিও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবার মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
এদিকে শনিবার সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমেছে সুরমা নদীর পানি। তবে প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে আরও অন্তত পাঁচদিন লাগবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
নগরে পানি কিছুটা কমলেও কমেনি বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীনতা, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি উপদ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। সিলেটে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। সিলেট জেলায় শতাধিক ব্যক্তি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জেলা সিাভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
সিলেটের জকিগঞ্জের আটগ্রাম এলাকার বাসিন্দা তোফায়েল আহমদ বলেন, 'আটদিন ধরে ঘরে পানি। পানির কারণে ঘর থেকে বেরও হতে পারছি না। ফলে খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাইনি।'
একই অভিযোগ করে জৈন্তাপুরের ফতেহপুর এলাকার শোয়েব হাসান বলেন, 'ত্রাণ তো দূরে থাক এই কয়দিনে আমাদের কেউ দেখতেও আসেনি। বন্যার কারণে আয়-রোজগার বন্ধ। এভাবে বসে বসে কয়দিন চলবে।'
খাবারের সাথে খাবার পানিরও সঙ্কট জানিয়ে নগরের ঘাসিটুলার এক বস্তির গৃহিনী রোমেনা বেগম বলেন, 'খাওয়ার পানি পাচ্ছি না কোথাও। পানি কিনে খাওয়ারও সামর্থ নাই। ত্রাণও পাইনি এ পর্যন্ত।'
গত বুধবার কিছু চাল পেয়েছিলেন জানিয়ে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগার এলাকার দিনমজুর রুবেল আহমদ বলেন, 'কেবল চাল দিয়ে কিভাবে চলে। আর চুলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাড়িতে তো রান্না করারও সুযোগ নেই।'
তবে পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, 'আমাদের হাতে এখনও ১০০ মেট্রিক টন চাল রয়েছে। আজকেও বিভিন্ন ইউনিয়নে ৮৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছি। ইতোমধ্যে ৩০৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। নগদ অর্থও বিতরণ করা হচ্ছে।'
কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ নিয়ে হট্টগোল
শনিবার সকালে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন ও বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে কোম্পানীগঞ্জ যান প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। মন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণের খবরে সকালে উপজেলা পরিষদের সামনে জড়ো হন হাজারও মানুষ। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাত্র ২০০ প্যাকেট ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়। ত্রাণগ্রহীতাদের তালিকাও আগের দিন করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, সকালে ৪/৫ জনের হাতে প্যাকেট তুলে দিয়ে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী ইমরান আহমদ। এরপর তিনি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর ত্রাণ নিয়ে বন্যার্তদের মাঝে কাড়াকাড়ি ও হট্টগোল শুরু হয়। এসময় পরিস্থিতি শান্ত করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে।
ত্রাণ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পাথর শ্রমিক নিয়াজ আহমদ বলেন, 'ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা তাদের পছন্দের লোকদের দিয়ে তালিকা করেছেন। আমরা প্রায় অভুক্ত অবস্থায় আছি কিন্তু আমাদের নাম তালিকায় উঠছে না।'
তিনি বলেন, 'বন্যার কারণে পাথর তোলা বন্ধ। ঘর থেকে বের হওয়ারও উপায় নেই। এখন আমরা কিভাবে খেয়ে বাঁচবো?'
ত্রাণ নিতে আসা কোম্পানীগঞ্জের বর্ণি এলাকার বাসিন্দা হাসমত আলী বলেন, 'ঘরে এক সপ্তাহ ধরে পানি। খাবারও নেই। মন্ত্রী ত্রাণ নিয়ে এসেছেন শুনে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু ত্রাণ তো পাইই-নি, উল্টো পুলিশের মার খেলাম।'
তবে লাঠিপেটার কথা অস্বীকার করে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী বলেন, 'সীমিত সংখ্যক ত্রাণের প্যাকেট ছিল। কিন্তু মানুষ জড়ো হয়েছিলো অনেক বেশি। এসময় উপস্থিত মানুষের মধ্যে হট্টগোল ও হাতাহাতি হয়েছে। পুলিশ তাদের শান্ত করেছে। তবে কাউকে লাঠিপেটা বা মারধর করেনি।'
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানের জন্য আগের দিনই ১২০ জনের তালিকা করা হয়েছিল। তাদের ত্রাণ নেয়ার জন্য সকালে উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে আসার জন্য বলা হয়। কিন্তু সকালে হাজারখানেক মানুষ সেখানে জড়ো হওয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজং বলেন, 'আমরা আজকে ত্রাণ বিতরণের জন্য ১২০ জনের তালিকা করেছিলাম। তবু ২০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী রাখা হয়েছিলো। কিন্তু তালিকার বাইরেও প্রচুর মানুষ এসে যাওয়ায় একটু ঝামেলা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আজকে মন্ত্রী ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন। যেহেতু মন্ত্রীর অনুষ্ঠান, তাই বেশি মানুষকে বলা হয়নি। কিন্তু আমাদের কাছে পর্যাপ্ত সংখ্যক ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে বন্যাকবলিত সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।'
এর আগে ত্রাণ বিতরণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক ত্রাণ আছে। ত্রাণ সামগ্রীর অভাব নেই। প্রশাসন ইতোমধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে।'
বন্যার্তদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, 'আপনারা নিশ্চিত থাকেন, আপনাদের কয়েকদিনের জন্য একটু কষ্ট করতে হবে। আমরা চেষ্টা করবে কীভাবে আপনাদের কষ্ট কমানো যায়। আর পানি নেমে যাওয়ার পর আপনাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।'
গত ১১ মে থেকে ঢল ও অতিবৃষ্টিতে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর একটি। এই উপজেলার প্রায় সবকটি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়। এতে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছেন। আর জেলায় মোট পানিবন্দি রয়েছেন ১৫ লাখ মানুষ।