নেপালে বিমান উড্ডয়ন এত ঝুঁকিপূর্ণ কেন?
নেপালকে প্রায়ই বিমান উড্ডয়নের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি বলা হয়। সম্প্রতি দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনায় ২২ যাত্রীর মৃত্যু বিশ্ববাসীকে আবারও যেন সেই বিপদ ও ঝুঁকির কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
গত ২৯ মে তারা এয়ার ফ্লাইটের একটি বিমান ভূমি থেকে প্রায় ১৪,৫০০ ফুট উপরে হিমালয়ের একটি পর্বতের উপর আছড়ে পড়ে। অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক ডেটাবেজ বলছে, এটি ছিল গত ১০ বছরের মধ্যে নেপালের ১৯তম বিমান দুর্ঘটনা এবং একই সাথে ১০ম প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা।
তদন্ত কর্মকর্তারা যখন আসল ঘটনা অনুসন্ধানে ব্যস্ত, তারই মধ্যে মঙ্গলবার বিমানটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে জানিয়েছেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার ধরন, কম দৃশ্যমানতা এবং পাহাড়ি ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নেপাল বিমান ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং দেশটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
বিশেষ করে এবারের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে খারাপ আবহাওয়ার বড় ভূমিকা ছিল বলে জানান নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিনোদ বি.কে। নেপালের জলবিদ্যা ও আবহাওয়াবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার সময় পোখারায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল- 'মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও বজ্রপাতসহ সাময়িক বৃষ্টিপাত হতে পারে।'
গত রোববার তারা এয়ারপ্লেন সেন্ট্রাল নেপালের পোখারা থেকে টেক অফ করে। গন্তব্য ছিল দেশটির জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট জমসম, যেখানে পৌঁছাতে বিমানে সময় লাগে ২৫ মিনিট। কিন্তু অর্ধেক পথ যাওয়ার পরেই বিমানটি এয়ার কন্ট্রোলের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে জানায় নেপালের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ।
খারাপ আবহাওয়া, স্বল্প দৃশ্যমানতা এবং দিনের আলো কম থাকায় প্রাথমিক অনুসন্ধান এবং নেপালের সেনাবাহিনীর উদ্ধারকাজেও যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু পর্বতমালার উপরে হেলিকপ্টার পাঠানোর ফলে সোমবারে বিমানের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করা সম্ভব হয় এবং প্রথম মরদেহ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর প্রকাশিত ছবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মঙ্গলবার খারাপ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও উদ্ধারকারী বাহিনী তাদের কাজ চালিয়ে যায় এবং অবশেষে সব মরদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়।
বৈরী ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য
নেপালে বিমান উড্ডয়নের ক্ষেত্রে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াই একমাত্র সমস্যা নয়। নেপালের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের ২০১৯ সালের এক নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালের বৈরী ও প্রতিকূল ভৌগলিক অবস্থানই দেশটির পাইলটদের জন্য সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পর্বতের ৮টি ই অবস্থিত নেপালে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট তো আছেই, সাথে ছোটবড় অসংখ্য পর্বতমালার সৌন্দর্য্যের টানে এই দেশটিতে ছুটে আসেন বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটক ও পর্বতারোহীরা।
কিন্তু এই সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ভূখণ্ডই আকাশপথে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়। সেই সাথে দেশের বিভিন্ন দুর্গম ও পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট বিমানের ব্যবহার এই পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে।
দেশটির বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯ বা তার চেয়ে কম আসনের ছোট বিমানগুলোই খারাপ আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু দেশটির প্রধান ট্রানজিট কেন্দ্র এবং এখান থেকেই এসব ছোট ছোট ফ্লাইট ছাড়া হয়।
নেপালের উত্তরপূর্বাঞ্চলের লুকলা শহরের বিমানবন্দরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর। এভারেস্টের গেটওয়ে হিসেবে পরিচিত এই বিমানবন্দরের রানওয়ে আসলে পর্বতশ্রেণীর মাঝখানে একটি ঢালে অবস্থিত যা সোজা নেমে গেছে নিচের দিকে। তাছাড়া, বিনিয়োগের অভাবে বহু বছর পুরনো বিমান ব্যবহার করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের একটি সহযোগী সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) নেপালকে তাদের অ্যাভিয়েশন সেফটি ইমপ্লিমেন্ট অ্যাসিস্টেন্স পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে সহযোগিতা করে। দুই বছর পরে, আইসিএও ও নেপাল একটি অংশীদারিত্ব ঘোষণা করে, যারা দেশটিতে বিমান ভ্রমণের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপত্তা ইস্যুতে নেপালের পরিস্থিতি উন্নত হলেও, চ্যালেঞ্জগুলো এখনো রয়েই গেছে।
২০১৬ সালে তারা এয়ারফ্লাইটের আরো একটি বিমান এই একই রুটে বিধ্বস্ত হয়। সেই দুর্ঘটনার জেরেই বিভিন্ন শর্তে তারা টুইন অটার বিমানটি পায়।
এর আগে ২০১৮ সালে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুগামী একটি বিমান অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয় এবং বিমানে আগুন ধরে যায়। এ দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ৭১ যাত্রীর ৫১ জনই নিহত হন।
সূত্র: সিএনএন