পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল: এখনও অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ
চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) জুলাই মাসে জাহাজ ভেড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বন্দরের। কিন্তু টার্মিনাল পরিচালনায় কোন প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত হচ্ছে তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম বন্দর। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯২ শতাংশ। ৩২ একর জায়গায় নির্মাণ হওয়া পিসিটিতে বছরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টিইইউজ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করা যাবে। পিসিটিতে তিনটি কনটেইনার ও একটি তেল খালাসের (ডলফিন) জেটি থাকছে। একসঙ্গে ভেড়ানো যাবে চারটি জাহাজ।
সমুদ্রপথে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। বর্তমানে এ বন্দরে জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নামে তিনটি টার্মিনালে ১৯টি জেটি রয়েছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল চালু হলে জেটির সংখ্যা দাঁড়াবে ২৩টিতে। বর্তমান বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তে পারে। পিসিটিতে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজও ভিড়তে পারবে।
এদিকে এই প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বন্দর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছেন, কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও যন্ত্রপাতি এবং অপারেটর নিয়োগ না হওয়ার কারণে সুফল পেতে দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগে যাবে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিধি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালু হচ্ছে সরাসরি জাহাজ চলাচল। সীমিত যন্ত্রপাতি দিয়ে এসব কাজ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বন্দর। এমনিতেই চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। তার অন্য টার্মিনালের যন্ত্রপাতি পিসিটিতে আনা হলে সেখানে সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বন্দরে হ্যান্ডেলিং কার্যক্রমে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ২৬টি গ্যান্ট্রি ক্রেন প্রয়োজন। এর মধ্যে বন্দরের আছে ১৬টি। এছাড়া কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম দ্রত সম্পন্ন করতে রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন ৪১ থেকে ৫২, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার ৪৫ থেকে ৮০, রিচ স্ট্যাকার ২৬ থেকে ৪০টি এবং কনটেইনার মুভার ৮ থেকে ১৫টিতে উন্নীত করা প্রয়োজন।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের কাজ শেষ হয়েছিলো। কিন্তু এই টার্মিনালে গ্যান্টি ক্রেন সহ উন্নতমানের যন্ত্রপাতি যোগ হয় ২০১৮ সালে। একই ধরনের পরিস্থিতি পিসিটির ক্ষেত্রেও ঘটে কিনা এই আশংকা ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "এনসিটি নির্মাণের পরও যন্ত্রপাতি না থাকায় কয়েক বছর পড়ে ছিলো এই টার্মিনাল। পিসিটিতেও এমন দীর্ঘসূত্রিতার কোন প্রয়োজন নেই। তাই দ্রুত যাতে এই প্রকল্প কাজে আসে এমন ব্যবস্থা করা উচিত। যেভাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিধি বাড়ছে সেটি সামাল দেওয়ার জন্য এই টার্মিনালে 'অনটাইম' কার্যক্রম শুরু করার কোন বিকল্প নেই।"
শুরুতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার কথা ছিলো। পরবর্তীতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) আওতায় বিদেশী অপারেটর দিয়ে পিসিটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে জুলাইয়ের মধ্যে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ না হলে বন্দরের যন্ত্রপাতি দিয়ে পিসিটির অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করবে বন্দর।
পিসিটির প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান সরকার টিবিএসকে বলেন, "ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ এ পর্যন্ত ৯২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জুলাইতে পিসিটিতে জাহাজ ভেড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বাকি কাজ এগিয়ে চলেছে। অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় দেখছে।"
বন্দর সূত্র জানায়, প্রাথমিক অবস্থায় পিসিটিতে শুধু জেটি সুবিধা ব্যবহার করা হবে। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো 'কী গ্যান্ট্রি ক্রেন' দেবে না। শুরুতে শুধু ক্রেনযুক্ত জাহাজই ভেড়ানো হবে।
পিসিটিতে 'ইক্যুইপ, অপারেট এন্ড মেইনটেইন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল' প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ হবে বিদেশী অপারেটর প্রতিষ্ঠান। পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) এর মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পিসিটি পরিচালনা ও বিনিয়োগে বিদেশী পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ডেনমার্কের এপি মুলার, সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি), আরব আমিরাতের দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড (ডিপি ওয়ার্ল্ড), ভারতের আদানি পোর্ট এন্ড স্পেশাল ইকোনোমিক জোন লিমিটেড (এপিএসইজেড) এবং পিএসএ সিঙ্গাপুর। এর মধ্যে এপি মুলার, আরএসজিটি এবং ডিপি ওয়ার্ল্ড আলোচনায় রয়েছে বলে জানায় চট্টগ্রাম বন্দরের একটি সূত্র।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপারেটর প্রতিষ্ঠান টার্মিনালটির দায়িত্বে থাকবে। হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্টও আনবে তারাই। চুক্তির মেয়াদ শেষে ইকুইপমেন্ট বন্দরের মালিকানায় চলে আসবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের অধিক সংখ্যক জাহাজ বার্থিং, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং কনটেইনার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।
সম্প্রতি পিসিটি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, "যতক্ষণ অপারেটর নিয়োগ না হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করবে। বন্দরের যেসব ইকুইপমেন্ট রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে এই টার্মিনাল পরিচালনা করা যাবে। পিপিপি অথোরিটি অপারেটর নিয়োগে কাজ করছে। আশা করছি সহসা অপারেটর নিয়োগ হয়ে যাবে।।"
চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে কন্টেইনার কনটেইনার হয় ৩০ লাখ টিইইউসের বেশি। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করেছিলো ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ টিইইউস কনটেইনার।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৩ জুন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। ওই সময়ে কাজ শেষ হয় ৪৫ ভাগ। দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলো বন্দর। এ সময়ে কাজ শেষ হয় ৭০ ভাগ। ফলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে তৃতীয় দফায় ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত এক বছর সময় বাড়ানো হয়।
প্রকল্পটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৫৮৩ মিটারের কন্টেইনার জেটি (৩টি বার্থ), ১টি ২০৪ মিটারের ডলফিন জেটি, ৮০ হাজার বর্গমিটার আরসিসি পেভমেন্ট/ ইয়ার্ড, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার, ১ দশমিক ২০ কিমি ৪-লেন রাস্তা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মিত হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের তত্ত্বাবধানে বিদ্যুতায়ন কাজ, সিসিটিভি স্থাপন কাজ, পাইলট বোট ও স্পিড বোট, পিকআপ, ফায়ার ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি ক্রয় করা হবে।