আন্তর্জাতিকভাবে এক দুর্বল আমেরিকাকে কি দেখছি আমরা!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ছয়জন বিচারক নারীদের দীর্ঘ স্বীকৃত গর্ভপাত করার অধিকারকে বাতিল করে দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বিচারকদের মধ্যে ছয়জনই রিপাবলিকান দলের মনোনীত বিচারক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা আমৃত্যু বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। বর্তমানে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত বিচারক মাত্র তিনজন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা আছে, সর্বোচ্চ নয়জন। আমাদের দেশের মতো প্রয়োজন অথবা নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা অনুসারে বিচারকের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে দেশটির দলীয়ভাবে বিভাজিত সুপ্রিম কোর্ট। সেটি নারীর গর্ভপাতের অধিকার। ১৯৭৩ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত ছিল। অর্থাৎ নারী গর্ভধারণ করবে কি না, তা স্বাধীন চিন্তায় সিদ্ধান্ত নেবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না, কানাডা ও ইউরোপের সকল দেশে একই আইন বহাল ছিল।
কিন্তু আমেরিকায় দীর্ঘদিন যাবৎ রিপাবলিকান ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে গর্ভধারণের বিষয়টি নিয়ে নানান মত চলছিল। সুপ্রিমকোর্টের এই রায়কে ভ্যাটিক্যান সমর্থন করেছে, তবে ব্রিটেন ও স্পেনের প্রধানমন্ত্রী এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন এই সিদ্ধান্ত নারীর মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি রাজ্য তাৎক্ষণিকভাবে এই রায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে এবং দেশের কংগ্রেসের স্পিকার ও প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে নারীদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছেন। প্রেসিডেন্ট নিজেও এই রায়ের বিপক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। যদিও আইনগতভাবে তার তেমন কিছু করার নাই। দেশটির রাজ্যগুলি এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অনেকগুলো রাজ্য বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে আর অনেকগুলো রাজ্যে পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের গভর্নর এই আইনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমেরিকার যেকোনো রাজ্যের নারীকে তার রাজ্যে গর্ভপাত করার অধিকার দেওয়া হবে। অন্যদিকে সিনেটের রিপাবলিকান দলের নেতারা এই রায়কে সমর্থন করেছেন। দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন এখন চূড়ান্তভাবে নানান সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। যে মুহূর্তে জো বাইডেন আন্তর্জাতিকভাবে খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, সেই সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ অঙ্গনে এ ধরনের একটি সামাজিক বিভাজন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
গত কয়েক দশকে এত দ্রুত আন্তর্জাতিক বিষয়ে সরাসরি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমা দেশগুলো কিংবা চীন, রাশিয়া কখনো তেমন মত প্রকাশ করেনি, যেমনটি এবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে ভারত, চীনসহ আরো অনেক দেশের কাছ থেকে হয়েছে। উত্থাপিত বিভিন্ন প্রস্তাবসহ আরো বহু দেশ সরাসরি বিরোধিতা করেছে মার্কিনীদের। আমরাও মার্কিনীদের সঙ্গ দিইনি। অতীতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার মতন অবস্থা বিশ্বে এবারের মতন কখনো দেখা যায়নি। রাশিয়ার ওপর নানান অবরোধের ঘোষণা দেওয়ার পরেও রাশিয়ার কাছ থেকে বেশ কিছু দেশ তাদের প্রয়োজনীয় তেল ও গম ক্রয় করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ হয়ে দেখছে। ভারতের বিপক্ষে তেমন কোনো পদক্ষেপ মার্কিনীরা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এবারকার ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে রাশিয়ার পুতিন বিশ্বের দেশগুলোর কাছে তার সাথে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রিকস সম্মেলনে ব্রিকসের অপর সদস্য দেশগুলো ইউক্রেন রাশিয়ার মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধ নিয়ে সরাসরি কোন মন্তব্য করেনি। তাদের অর্থনৈতিক বিষয় ছাড়া আর কোনো বিষয় সামনে আসেনি। বরং ধারণা করা হচ্ছিল রাশিয়ার ওপর মার্কিনীদের যে নিষেধাজ্ঞা কিংবা সম্মেলনের আগেরদিন চীনের একটি অঞ্চলের উপর নিষেধাজ্ঞা হয়তো প্রভাব পড়বে ব্রিকস সামিটে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। পাশাপাশি ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে রাশিয়া তারা অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। দুদিন আগেই মাত্র আরেকটি ভূখণ্ড থেকে ইউক্রেন তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এদিকে গত সপ্তাহে ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরের সামনে ন্যাটো বিলুপ্তির দাবি তুলেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বহুদেশের মানুষেরা।
আন্তর্জাতিকভাবে এমন একটি দুর্বল কূটনীতিক অবস্থানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দেশকে আরো বিভক্তির পথে নিয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর কিংবা অকার্যকর করার ক্ষমতা মার্কিন সিনেট কিংবা মার্কিন প্রেসিডেন্ট কারোরই নেই। তারপরেও বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে, তা বিশ্ব রাজনীতির উপর প্রভাব পড়বে। একদিকে অর্থনীতিতে চলছে প্রায় ২৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। মধ্যবিত্ত জীবনের মানুষের সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি ধর্মীয়ভাবেও নতুন বিভাজন সৃষ্টি করা হলো। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ১৭৯১-এ ধর্ম নিয়ে কোন আইন করার ক্ষমতা কংগ্রেসের কাছ থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, তার পরেও সুপ্রিম কোর্টের রায় ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে এক পক্ষ অর্থাৎ রিপাবলিকানরা তাদের ধর্মীয় চেতনা থেকেই এই গর্ভপাত বিরোধী আইন করার পক্ষে, বহুদিন যাবত তারা আন্দোলন করছে।
এখন আমেরিকা কীভাবে সামাল দেয়, পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, দেখার অপেক্ষা।