কোভিড-১৯ এ বয়োবৃদ্ধদের হারিয়ে বিপন্ন বহু ভাষা!
কোভিড-১৯ মহামারিতে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা। হাজার হাজার বছর প্রাচীন এ ভাষাগুলো মুখেমুখে চর্চা করতো অরণ্যচারী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী। বয়স্ক সদস্যদের কাছ থেকেই আদি ভাষার পাঠ পেতো গোষ্ঠীর নবীন সদস্যরা।
কিন্তু, মহামারি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অরণ্য আমাজনে হানা দেওয়ায় মৃত্যু বেড়েছে জ্যেষ্ঠ আদিবাসীদের। এমনই একটি হারিয়ে যাওয়া ভাষা হচ্ছে; পুরুবরা। চলতি বছর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে করোনা সংক্রমণে মারা যান ৯২ বছরের এলিজার পুরুবরা। তার মৃত্যুর সাথে সাথে গোষ্ঠীটির আদি ভাষার জীবন্ত ভাণ্ডারটিও হারিয়ে গেছে।
মহামারি নতুন হুমকি হলেও, ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের পর থেকেই ব্রাজিলের আদিবাসীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়া শুরু করে। এক সময় প্রায় দেড় হাজার ভাষা প্রচলিত ছিল অরণ্যচারী সম্প্রদায়গুলোতে। আজ তার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮১টি'তে! টিকে থাকা এই কথ্যরূপগুলোই এখন মহামারির নতুন বিপদের করাল থাবায় বিলুপ্তির মুখে।
গুয়ারানি মাবইয়া গোষ্ঠীর মতো যাদের জনসংখ্যা কয়েক হাজার তাদের মাতৃভাষা ইউরোপীয়দের আগমনের পরও অস্তিত্ব ধরে রাখতে পেরেছে। হুমকি আছে তুলনামূলক ছোট পুরুবরা'র মতো গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে, ভাষার নামেই তাদের নামকরণ। আর বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা মাত্র ২২০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
মহামারি ইতোমধ্যেই সঙ্কটের এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে। সীমিত সংখ্যায় টেস্ট করা সম্ভব হলেও, এপর্যন্ত ব্রাজিলের ৩৯ হাজারের বেশি অরণ্যচারী আদিবাসীর মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। পুরুবরা গোষ্ঠীর ছয় সদস্যও ছিলেন এদের ভেতর। উপাত্ত সংরক্ষণের উপায় তেমন না থাকা স্বত্বেও, আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ৮৭৭ জনের মৃত্যুর কথা জানা গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে কোভিড-১৯ ব্যাধিটির প্রকোপে এলিজারের মতো বয়স্কদের প্রাণহানিতে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ভাষার সংযোগ সেতুর কাজ করতেন এই বৃদ্ধরা। ছিলেন মাতৃভাষার সংরক্ষক আর শিক্ষক।
তাছাড়া, করোনাভাইরাসের কারণে বনপ্রান্তে বসবাসকারী অনেক সম্প্রদায় পড়েছে কোয়ারেন্টিনের আওতায়। একে-অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। ফলে সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ সদস্যের সঙ্গে মাতৃভাষা শেখা ও চর্চার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে নবীনেরা।
আর ভাষা তো শুধু ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম নয়, এটি তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ধারক। ফলে শেকড় থেকেও তরুণ ও শিশু-কিশোরদের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। নৃগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণাকারী এবং ভাষা বিজ্ঞানীরা একারণেই উদ্বিগ্ন।
ইউরোপীয়দের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই মহাবন আমাজনের উজাড় হওয়া শুরু হয়। বনজ সম্পদ আহরণ লাভ করে শিল্পায়নের গতি। অধিগ্রহণ করা হয় আদিবাসীদের অনেক চারণভূমি। ভাষার এই বিপন্নতা তাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
পুরুবরাদের ট্রাজেডিও এই ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়ের অংশ।
১৮২২ সালে পর্তুগাল থেকে স্বাধীন হয় ব্রাজিল। তারপর গঠিত হয় আদিবাসী সম্পর্ক বিভাগ। প্রায় এক শতাব্দী আগে এই বিভাগের আওতায় গঠিত হয় ইন্ডিয়ান প্রোটেকশন সার্ভিস। সংস্থাটি অরণ্যে বন্য সম্পদ আহরণের কাজ শুরু করে। তাদের হয়ে ইউরোপীয় বংশভূত রাবার বেনিয়ারা আসে রোডেনিয়া প্রদেশের পুরুবরাদের বনে।
নারী-পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সবাইকেই ক্রীতদাসের মতো রাবার গাছের রস সংগ্রহে বাধ্য করে তারা। নতুন এই প্রভুরা পর্তুগিজ ভাষা শেখা এবং শুধু তার মাধ্যমেই ভাব-বিনিময়ে বাধ্য করে। সোজা কথায়, মাতৃভাষার স্বাধীনতাও হারায় দুর্ভাগা পুরুবরা জনগোষ্ঠী।
এলিজারও ছিলেন ওই সময়ের স্বাক্ষী। কিন্তু, তিনি তার ভাষার জ্ঞানকে হারিয়ে যেতে দেননি। ১৯৪৯ সালে ইন্ডিয়ান প্রোটেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট বাতিল করা হয়। তখন থেকেই নিজের সংরক্ষিত ভাষার জ্ঞান নতুন প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা করতে থাকেন এলিজার।
এমন হাজারো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এলিজারদের মতো বয়স্করা তাই মহামূল্যবান। মহামারিতে তাদের মৃত্যু, প্রকৃতি আর বনচারী মানুষের লালিত কৃষ্টির বিনাশের গতি বাড়িয়েছে শুধু।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক