ঢাকা বোট ক্লাবের উত্থান-পতন: ক্ষমতা, অপরাধ ও বিতর্কের আখ্যান
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেড (ডিবিসিএল)।
তুরাগ নদীর এক মনোরম অংশে গড়ে ওঠা এই ক্লাব মূলত ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়।
এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেড (ডিবিসিএল) ঢাকার অন্যতম প্রধান নৌ-বিনোদন ও সামাজিক ক্লাব। এটি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বোট ক্লাব কখনোই "সাধারণ" মানুষের জন্য ছিল না। এর সদস্যরা ছিলেন মূলত ধনী ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
এই ক্লাব বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ছিল। এখানে বিলাসবহুল নৌভ্রমণের স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হত। অথচ, চারপাশে জলাশয় থাকলেও দেশে এ জাতীয় যথেষ্ট অবকাঠামো নেই।
কিন্তু সময়ের সাথে ক্লাবটির খ্যাতির চেয়ে বদনামই বেশি ছড়িয়েছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে থাকা এই ক্লাব অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া, ক্লাবটির বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগও ওঠে।
বিতর্কের মধ্যেও ক্লাবটি বিলাসিতার কিছুটা ছাপ ধরে রেখেছিল। এর পেছনে ছিল সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের সমর্থন। তিনি ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
তার প্রভাবের ফলে আইনি বাধাগুলো সহজেই দূর হয়ে যেত।
কিন্তু এরপর এলেন পরীমনি।
এক ঐতিহাসিক রাতে সবকিছু বদলে যায়। পরীমনি সেই ব্যক্তি হয়ে ওঠেন, যিনি শেষ পর্যন্ত ক্লাবের পতনের সূত্রপাত ঘটান।
দেশকে কাপিয়ে দিয়েছিল যে অপরাধ
২০২১ সালের ৮ জুন পরীমনি একটি চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেন।
তিনি দাবি করেন, ব্যবসায়ী ও ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ক্লাবে তাকে লাঞ্ছিত করেছিলেন।
তার ভাষ্যমতে, পোশাক ডিজাইনার অমি কৌশলে তাকে ক্লাবে নিয়ে যান। অমি জোর করে সেখানে থামার কথা বলেন।
ক্লাবে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, সেটি বন্ধ। তবে অমির ব্যবস্থায় প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়।
ভেতরে ঢুকে পরীমনি ও তার সঙ্গীরা নাসিরউদ্দিন মাহমুদের মুখোমুখি হন। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি (পরীমনি) মদ্যপানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নাসির ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
পরীমনি জানান, নাসিরউদ্দিন জোর করে তাকে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন, অশালীনভাবে স্পর্শ করেন এবং যাতে তিনি সাহায্য চাইতে না পারেন সেজন্য তার ফোন ছিনিয়ে নেন।
কিন্তু কোনোভাবে তিনি রাত ৩টার দিকে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বিচার দাবি করেন।
এই ঘটনার পর নাসিরউদ্দিন ও অমিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাশাপাশি উত্তরার একটি আলাদা স্থান থেকে তিন তরুণীকে আটক করা হয়। তাদের কাছে নিষিদ্ধ ইয়াবা, বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া যায়।
ডিবি'র যুগ্ম কমিশনার তখনকার এক বিবৃতিতে জানান, নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ব্যবহার করার অভিযোগও ছিল।
কর্তৃপক্ষ ইঙ্গিত দেয়, ক্লাবটির সঙ্গে জড়িত আরও বড় একটি অবৈধ মদ ও দেহব্যবসার চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর ফলে সেখানে চলমান অপরাধের মাত্রা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়।
তবে পরে নাসিরউদ্দিন ঢাকার একটি আদালতে পরীমনি ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে হামলা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেন।
পরীমনির অভিযোগের পর ঢাকা বোট ক্লাব নিয়ে সংসদেও উত্তপ্ত আলোচনা হয়।
সংসদ সদস্যরা প্রশ্ন তোলেন, দখলকৃত জমিতে কীভাবে একটি ক্লাব চালু থাকতে পারে এবং একজন আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা আইনসম্মতভাবে এর সভাপতি হতে পারেন কি না।
সরকার এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, এতে ক্লাবটির শক্তিশালী যোগাযোগ থাকার বিষয়ে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
পরীমনির অভিযোগের বাইরেও অবৈধ জমি দখলের অভিযোগ সামনে আসে।
২০১৪ সালে ক্লাবটি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ২৭ বিঘা জমি কিনেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু পরে এর মোট এলাকা বেড়ে প্রায় ৬০ বিঘা হয়।
স্থানীয় লিজধারীরা, যাদের মধ্যে সাবেক সাভার বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনও ছিলেন, দাবি করেন, ক্লাবটি তাদের খাস (সরকারি) জমি জোরপূর্বক দখল করেছে।
তাদের জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইদুর রহমান সুজন বলেন, "বোট ক্লাব আমার নামে লিজ করা ৭৭ শতাংশ জমি দখল করেছে। ক্লাবের একজন সদস্য আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, জমিটি ক্লাবের ব্যবহারের জন্য নেওয়া হবে এবং আমাকে বিষয়টি ভুলে যেতে হবে।"
তবে অল্প সময়ের মধ্যেই অভিযোগ ওঠে, ক্লাবটি তুরাগ নদীর তীরে দখল করা জমিতে অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, ক্লাবটি নির্মাণ করার সময় নদী সীমান্ত থেকে ২০০ গজের মধ্যে উন্নয়ন নিষিদ্ধ থাকার বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
পতন: উচ্ছেদের নির্দেশ
পরিবেশবাদী সংগঠন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর চাপ বাড়ার মধ্যেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) ২০২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বোট ক্লাবকে অবৈধভাবে দখল করা ১০.৭৩ একর জমি খালি করার নির্দেশ দেয়।
ক্লাবের সভাপতির উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এই জমি ঢাকা সমন্বিত বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্পের অংশ হিসেবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিগ্রহণ করেছে।
বোট ক্লাব অবৈধভাবে এই জমিকে তার সীমানা প্রাচীরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি দখলদারির শামিল।
নিয়ম মেনে চলতে ব্যর্থ হলে আইনি ব্যবস্থা এবং সম্ভাব্য উচ্ছেদের সম্মুখীন হতে হবে, যা একসময়ের মর্যাদাপূর্ণ ক্লাবটির চূড়ান্ত পতনের চিহ্ন।
এনআরসিসি আরও ঘোষণা দেয়, তারা ক্লাবটির জমি দখল পর্যালোচনা করা হবে এবং ভবিষ্যতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
ঢাকা বোট ক্লাবের উত্থান ও পতন বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন সুযোগ-সুবিধা ও বিচারহীনতার চিত্র তুলে ধরে।
যেখানে ক্লাবের শুরুটা হয়েছিল নদীর পাশে বিলাসবহুল বিশ্রামের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সেখানে পরবর্তীতে অপরাধ, দুর্নীতি এবং জমি দখলের মতো অভিযোগের সাথে ক্লাবটির নাম জড়িয়ে পড়ে।
এটি সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হবে কি না বা নতুন নেতৃত্বে চালু থাকবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
তবে একটি কথা স্পষ্ট: ঢাকা বোট ক্লাব আর মর্যাদার প্রতীক নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।