চাঁদে প্লট কিনছেন ভারতীয়রা, কারণগুলোও অদ্ভুতভাবে পরিচিত!
রিয়েল এস্টেটের কাছ থেকে চাঁদে জমি কেনার কথাটা একটু উদ্ভটই শোনাতে পারে। তবে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই এ কাজের পেছনে কয়েকটি কারণও খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের নিরাপত্তা বোধের অভাব, আশা, দর্প, ভালোবাসা।
দেরাদুনের ৩৯ বছর বয়সী হোটেল ম্যানেজার রজত রাজন মহামারির সময় চাঁদে প্লট বিক্রি করেছেন। প্রতি প্লটের মূল্য কয়েক হাজার রুপি।
'কথাটি শুনতে হয়তো অদ্ভুত লাগবে। কিন্তু সম্রাট আকবরের আমলে তাকে যদি কেউ বলত যে আমাদের আকাশে একদিন বিমান উড়বে, তার কাছেও সে কথা ঠিক আজকের মতোই অদ্ভুত লাগতো।'-এভাবে ব্যাপারটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
দুটো ব্যাপার অবশ্য একরকম নয়। রজতের কাজটি হয়েছে আকবরের আমলে প্লেনের টিকিট বিক্রির মতো। রজত কিংবা তার ক্রেতাদের কেউই পৃথিবীর উপগ্রহের মালিক হতে পারবেন না। বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
রজতের চাঁদে জমি বিক্রির এই ব্যাপারও অবশ্য ভাঁওতাবাজি। গত বছর মহামারির কারণে তার হোটেলের ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। তারপর গত বছরের জুলাইয়ে তিনি 'চান্দ পে জামিন' (চাঁদে জমি) নামের এই ব্যবসা শুরু করেন। কয়েক বছর আগে খবরের কাগজে মার্কিন উদ্যোক্তা ডেনিস হোপের চাঁদে প্লট বিক্রির খবর পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই এই বুদ্ধি আসে তার মাথায়।
১৯৮০ সাল থেকে চাঁদে ৬১১ মিলিয়ন একর জমি বিক্রি করেছেন হোপ। নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি লুনার এমব্যাসির মাধ্যমে এ ব্যবসা চালান তিনি।
হোপ দেখিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি চাঁদে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দাবি করতে পারবেন না, এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইনে কাগজে-কলমে নেই। এই আইনের আওতায় কোনো সরকার চাঁদে নিজের মালিকানা দাবি করতে পারবে না। আইনের এই ফাঁক ব্যবহার করে তিনি এবং তার মতো অন্যরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে চাঁদে জমি বিক্রি করার উপায় বের করাটা যতটা অদ্ভুত, তারচেয়েও অদ্ভুত হচ্ছে সেই জমি কেনার মতো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া। চাঁদে জমি কেনার জন্য রজত ও হোপের পেছনে রীতিমতো লাইন পড়ে গেছে। ২৪৯৯ রুপির বিনিময়ে রজত ক্রেতাকে একটি সনদপত্র দেন। সেখানে লেখা থাকে, এই সনদবাহী ব্যক্তি আকাশে এক একর জায়গার মালিক। তাতে আবার ম্যাপে ক্রেতার জমির অবস্থানও নির্দেশ করা থাকে। সাথে লেখা থাকে যে, এই দলিল 'উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য।'
মিরাটের রিয়েল ৩৩ বছর বয়সি এস্টেট ডেভেলপার রাহুল রানা। দুই মাস আগে তিনি রজতের কাছ থেকে ১০ একর জমি 'কিনেছিলেন'। জমি কেনার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, 'এই বুদ্ধিটা অনন্য। আর আমি সবসময়ই নতুন নতুন জায়গায় বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজি।'
রানা আরও বলেন, এই সম্পত্তির দখল তার কাছে মূলত একটি প্রতীকী ব্যাপার। তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সবার আত্মাই মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা কেউই পৃথিবী কিংবা চাঁদ কোথাওই কোনো সম্পত্তির মালিক নই।'
অর্থের বিনিময়ে রানা মূলত সামাজিক পুঁজির মালিক হয়েছেন। একটা কিছু নিয়ে গর্ব করার অধিকার জন্মেছে তার। এটি নিয়ে যে কোনো সময় আলোচনা শুরু করা যায়। এমন এক জিনিসের মালিক তিনি যা আশপাশের অন্য কারও কাছেই নেই। ঠিক এই কারণেই তো অনন্য মর্যাদার প্রতীক হিসেবে মানুষ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জিনিস কেনে, চড়া মূল্যে নানা ক্লাবের সদস্যপদ কেনে।
প্ল্যান অ্যাহেড ওয়েলথ অ্যাডভাইজরের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী বিশাল ধাওয়ান বলেন, 'সামাজিক মর্যাদার জন্যও মানুষ প্রচুর বিনিয়োগ করে। সেজন্য তারা এমন অনেক জিনিসও কেনে, যা নিয়ে লোকে কথা বলবে।'
যুক্তি বলে, আমাদের সব বিনিয়োগই নিরাপদ হওয়া উচিত। সেজন্য বেশিরভাগ বিনিয়োগই একঘেয়ে হয়ে থাকে। তবে ধাওয়ানের মতে, প্রায়ই বিনিয়োগকারীরা প্রচলিত মতের উল্টোপথে হাঁটতে চান। ক্রিপ্টোকারেন্সি, গ্রহাণুর 'নামকরণে'র অধিকার—এসবই এমন লগ্নির নমুনা। এসব লগ্নি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
সাইকিয়াট্রিস্ট ড. সোনাল আনন্দ মনে করেন ব্যাপারটি আরও গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। তার মতে, মহাশূন্যে জমির দখল নেওয়ার চিন্তা আসলে আমাদের অন্তর্জগতেরই প্রতিফলন। চাঁদে জমি কেনাটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ, অসুস্থতা এবং পৃথিবীতে আসন্ন তীব্র জায়গা সংকটের দুশ্চিন্তা থেকে সামান্য মুক্তির জন্য মানুষের পলায়নপর মনোভাবের প্রকাশও হতে পারে। আনন্দ বলেন, এ ধরনের জমি কেনাকে পরিবর্তিতে ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের প্রস্তুতিও বলা যেতে পারে।
চাঁদে এভাবে জমি কেনার আরেকটি কারণ হলো, এটি দারুণ ও অনন্য এক উপহার। এই উপহার নিয়ে সবাই আলোচনায় মাতবে (মাঝে মাঝে হয়তো নেতিবাচক আলোচনাও হবে)। এ কাজ দেখাবে, আপনি একটু অন্যরকম কাজ করতে চান। এছাড়াও এটি ভালোবাসা দেখানোরও একটি নিরব উপায়।
গুরুগ্রামের আইটি ইঞ্জিনিয়ার মহেশ রাও বলেন, 'এই উপহার হাতে ধরা যায় না, চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।'
মহেশ গত বছর চতুর্থ বিবাহবার্ষিকীতে তার স্ত্রী শীতলের নামে একটি তারার নামকরণ করেছেন। তিনি জানেন, ওই তারাটিকে তার স্ত্রীর নামে ডাকা হবে না। এমনকি ওটা হয়তো প্রকৃত তারাও নয়। মহেশকে বলা হয়েছে, ওই তারাকে দেখার জন্য তাকে চিলি যেতে হবে।
তবু সেই মুহূর্তে মহেশের কাছে ব্যাপারটি বিশেষ কিছুই হয়ে উঠেছিল। তারাটি তিনি ২২০০ রুপির বিনিময়ে কিনেছেন। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠাটি তাকে তারার নাম, একটি পুস্তিকা ও একটি নক্ষত্র-ম্যাপ পাঠিয়েছে। তার স্ত্রী তারা দেখতে ভালোবাসেন। পুস্তিকাটি যখন পৌঁছায় তখন দারুণ খুশি হয়ে ওঠেন তার স্ত্রী। মহেশের মনে হয়েছিল, এটিই তার সহধর্মিণীর জন্য সবচেয়ে ভালো উপহার।
- সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস