জীবজন্তুরা কীভাবে নেতা নির্বাচন করে, গায়ের জোর থেকে গণতান্ত্রিক উপায়ে
হাতি থেকে শুরু করে ডলফিনের মতো অনেক বন্য জন্তু একজন নেতা শাসিত সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। এই গোষ্ঠীগুলো অনেকটা সমবায়ের মতো। এবং মানব সমাজের মতোই প্রাণিদের মধ্যেও শাসকেরা ক্ষমতায় আসতে ভিন্ন পথ ও উপায় অনুসরণ করে।
যেমন বলা যেতে পারে শিম্পাঞ্জিদের কথা। শারীরিক আকার এবং চরিত্রের উপর নির্ভর করে, এদের কেউ কেউ গায়ের জোরে আবার কেউবা নিজ আচরণের গুণে মন জয় করে নেতা হয়ে ওঠে।
মানুষের মতোই নেতা নির্বাচনে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, বড় এক বিষয় প্রাণি জগতেও।
যেমন কুকুর প্রজাতির ফুটিওয়ালা হায়েনারা লিঙ্গ বা বংশক্রম অনুসারে নেতা বেছে নেয়। রাজতন্ত্রের মতোই হায়েনা সমাজে আছে মাতৃতন্ত্র। স্ত্রী হায়েনাই দলের নেতৃত্ব এবং দেখভালের দায়িত্ব পালন করে।
স্টিকেলব্যাক মাছেদের অবশ্য বংশধারা নিয়ে মাতামাতি নেই। দলের মধ্যে যে দেখতে বেশি সুন্দর, সবাই তাকেই অনুসরণ করে।
নেতাদের বয়স নিয়ে মানুষ প্রায়শ'ই উদ্বেগ প্রকাশ করে। বয়সের কারণে তাদের বুদ্ধিভ্রমের সুযোগ বেশি বা তারা দুর্বল বলেও মনে করা হয়। এই যেমন আসছে নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী; ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের বয়স নিয়ে এমন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।
জীবজন্তুদের কিছু প্রজাতি অবশ্য নির্দ্বিধায় বয়োজ্যেষ্ঠদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, জানান ক্যালিফোর্নিয়ার মিলস কলেজের প্রাণি আচরণ গবেষক জেনিফার স্মিথ।
''স্তন্যপায়ী প্রাণির দল অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান বেশি এমন নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেয়। তাই দলের বয়োজ্যেষ্ঠরা হয় বিশেষ সম্মানের অধিকারী। তাদের মধ্যে থেকেই সবচেয়ে অভিজ্ঞ একজন নেতৃত্ব দেয়,'' স্মিথ বলছিলেন। তিনি জানান, বয়স্ক স্ত্রী লিঙ্গের প্রাণিদের ক্ষেত্রে একথা বেশি প্রযোজ্য।
মাতৃতন্ত্রের শাসন:
স্থলভাগে সবচেয়ে বড় জন্তু- আফ্রিকান হাতি। তাদের পরিচালনা করে গোষ্ঠীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও বয়স্ক মাদি হাতি।
এই বয়স্কারা ৬০ বছর পর্যন্ত বাচতে পারে। অভিজ্ঞতা থেকেই তারা সিংহদের ডাক শুনে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জন্তু কোনটি তা বুঝতে পারে এবং তার আক্রমণ থেকে নিজ গোষ্ঠিকে রক্ষা করে। কেনিয়ার অ্যাম্বোসালই জাতীয় উদ্যানে করা এক গবেষণা সূত্রে এতথ্য জানা গেছে।
তাছাড়া, বয়স্কা মাদিদের স্মৃতি বেশ প্রখর। বিচরণ এলাকার ভূচিত্র এতে সঞ্চিত থাকে। সেই অনুসারেই দলকে তারা খাদ্য ও পানির মতো অতি-প্রয়োজনীয় উৎসের দিকে পরিচালিত করে। স্মিথ জানান, 'সম্মান এবং অর্জনের ভিত্তিতেই এ নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয়।'
কিলার হোয়েল বা ওর্কা প্রজাতির তিমিরাও জ্যেষ্ঠ নারীকে অনুসরণ করে। শেষ সন্তান জন্ম দেওয়ার পর স্ত্রী ওর্কারা ৫০ বছর পর্যন্ত দলকে পরিচালনা করে। জ্যেষ্ঠ নারী নেতৃত্বের বড় সুবিধা হলো, দলের প্রায় সকলেই তার আত্মীয়। তাই সকলকে সুরক্ষিত রাখার একটি স্বাভাবিক তাড়না কাজ করে এমন নেত্রীর মধ্যে।
ওর্কা নেত্রীরা দলকে বেশি মাছ পাওয়া যাবে এমন এলাকায় নিয়ে যেতে পারে, বলে সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় দেখা গেছে। এবং বয়স্কা ওর্কা নেত্রীর মৃত্যুর পর তার নাতি-নাতনীদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বাড়ে, বলেও গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়।
এব্যাপারে স্মিথ জানান, ''মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয় খাদ্যের অভাব দেখা দিলে। একারণেই দাদি/নানী'র প্রাকৃতিক পরিবেশের অভিজ্ঞতা কিছু প্রাণি সমাজের টিকে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত।''
অভিজাততন্ত্রের শাসন:
আফ্রিকার ফুটিওয়ালা হায়নাদের একটি গোষ্ঠীতে ১৩০ জন সদস্য থাকতে পারে। জন্মের পর থেকেই প্রত্যেক স্ত্রী হায়েনাকে একটি পূর্ব নির্ধারিত সামাজিক পদ-মর্যাদা মেনে চলতে হয়।
এই হায়েনাদের মধ্যে থেকে রানি হায়েনাকে বেঁছে নেওয়া হয় তার মায়ের পরিচয়ের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, মা নেত্রী হলে তার কন্যার সেই দায়িত্ব গ্রহণের সম্ভাবনাটাই বেশি। এটা সামাজিক সম্মতিতে পারিবারিক জ্ঞান এবং ক্ষমতার হস্তান্তর, বলে জানান স্মিথ।
হায়েনাদের দুর্নাম থাকলেও, তারাই আফ্রিকার সবচেয়ে সফল শিকারি। একটি হায়েনা গোষ্ঠীতে একাধিক পরিবার যূথবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সব পরিবারের উপরে প্রতিপত্তি শাসক বা রাজকীয় পরিবারের। অন্যান্য প্রত্যকে পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট পদ-মর্যাদা আছে। সেই অনুসারেই তারা খাদ্যের ভাগ পেয়ে থাকে।
স্মিথ জানান, হায়েনা গোষ্ঠীতে স্ত্রী'রা জীবন-যাপনের সকল ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেয়।
আসুরিক শক্তি:
শিম্পাঞ্জি দলের নেতৃত্ব দেয় যে প্রধান পুরুষটি, তার প্রধান আগ্রহ প্রজনন ঘিরে। নেতা হিসেবে সে সবচেয়ে উর্বর স্ত্রী শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মিলিত হতে পারে আর সবচেয়ে বেশি সন্তানের জনক হওয়ার সুযোগ পায়।
নেতা শিম্পাঞ্জি দলের ঝগড়া-বিবাদ থামিয়ে শান্তি বজায় রাখে এবং খাদ্যের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া, দলের অন্য পুরুষদের মধ্যে কারা মাদিদের সঙ্গে প্রজননের সুযোগ পাবে, সেটা নির্ধারন করে দেওয়াটাও নেতার দায়িত্ব। নিজ সমর্থকদের দেওয়া এটি তার জনপ্রিয় রাজনৈতিক উপহার।
প্রধান পুরুষ অবশ্য জন্ম থেকেই কেউ হয় না। অন্য পুরুষদের আকস্মিক বিদ্রোহ নিয়েও তাদের সতর্ক থাকতে হয়। একারণেই শিম্পাঞ্জিদের বেশিরভাগ নেতৃত্ব কায়েমি স্বার্থপর চরিত্রের হয়। বেশিরভাগ সময় তারা দলের অন্যদের ত্রাস আর ভয়ের মধ্যে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে, বলে জানান মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি বিজ্ঞানী মাইকেল উইলসন।
জোট তৈরি:
সবসময় অবশ্য পেশিশক্তি কাজ করে না। ছোট আকারের এবং তুলনামূলক কম আগ্রাসী কিছু শিম্পাঞ্জিও দলের নেতা হয়। তাদের কৌশলটা খুবই ভিন্ন। তারা জোট গঠনের মাধ্যমে সমর্থন তৈরি করে।
তাঞ্জিনিয়ার গম্বে স্ট্রিম জাতীয় উদ্যানে এমনই একটি নেতা পুরুষ শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করেন উইলসন। তার নাম দিয়েছিলেন ফ্রয়েড। এই শিম্পাজিটি দলের অন্য পুরুষদের সঙ্গে জোট গঠন করে নেতৃত্ব দিত। পুরুষদের দেখভাল করে এবং বেশিরভাগ সময় তাদের সঙ্গে কাটিয়ে সে তাদের আনুগত্য ধরে রাখার সফলতা দেখিয়েছিল।
কিছু কিছু নেতা শিম্পাঞ্জি আবার শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পছন্দ করে। তাদের আদর করে সুরসুরিও দেয়, ঠিক যেমন করে জনতার মন জয়ে রাজনীতিবিদেরা শিশুদের গালে চুমু খান- তেমন ব্যাপারই আর কি।
ফ্রয়েডও শিশুদের সঙ্গে খেলা করতো। এভাবে স্নেহ আর যত্নের আদি রাজনৈতিক কৌশল বেঁছে নেওয়ায়, সে পেয়েছিল দলের সকলের একনিষ্ঠ আনুগত্য।
গণতন্ত্রের মরণ নৃত্য:
রানি মৌমাছিরা অবশ্য একটু সহিংস পূর্ব নির্ধারিত পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসে।
কর্মী মৌমাছিরা এক ডজনের মতো সাধারণ কর্মী মৌমাছিকে বিশেষ খাবার খাইয়ে তাদের রানি মৌমাছি হিসেবে বড় করে। বড় হওয়ার পর কর্মীরা সরে যায়, আর রানিদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে দেয়। শেষ পর্যন্ত যে বেঁচে থাকে সেই হয়ে ওঠে মৌচাকের মালকিন।
''অবশ্য মালকিন বলাটা সঠিক হবে না। তার মূল কাজ আসলে প্রজনন এবং ডিম পাড়া। এর বাইরে তার অন্য কোনো কাজ নেই,'' জানান কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক থমাস শিলি। তিনি 'হানিবি ডেমোক্রেসি' শীর্ষক একটি বইয়ের লেখক।
শিলিং আরও জানান, রানি মৌমাছি অবশ্যই একজন দক্ষ যোদ্ধা, কিন্তু সেটা না হলে তার বেঁচে থাকা বা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও থাকে না।
তবে জীবন-মৃত্যুর মতো গুরুতর সঙ্কট, যেমন বিপন্ন মৌচাক নতুন করে কোথায় গঠন করা হবে- রানি সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সফল একটি মৌচাক থেকে দলকে ভাগ করে আরেকটি চাক গঠনের ক্ষেত্রেও তার রায় মেনে নেয় কর্মী মৌমাছিরা।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক