ট্রাম্প আসার আগপর্যন্ত ‘মাটি কামড়ে’ পড়ে থাকার নির্দেশ যুদ্ধের ময়দানে ক্লান্ত ইউক্রেনীয় সেনাদের
কণ্ঠে উদ্বেগ, ক্লান্তি আর হতাশার মিশেল।
এক সৈনিক বললেন, 'পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে।'
আরেকজন বললেন, 'আমরা কোনো লক্ষ্য দেখতে পাচ্ছি না! এই ভূমি আমাদের নয়।'
প্রায় চার মাস আগে রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে আকস্মিক হামলা চালায় ইউক্রেনীয় বাহিনী। কিন্তু এখন সেখানে অবস্থানকারী সৈন্যদের পাঠানো বার্তায় উঠে আসছে যুদ্ধের হতাশাজনক চিত্র। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য তারা পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না—এবং হারের ভয় তাদের আরও শঙ্কিত করে তুলছে।
টেলিগ্রামের মাধ্যমে কুর্স্কে কর্মরত কয়েকজন ইউক্রেনীয় সেনার সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাদের একজন সম্প্রতি ফ্রন্টলাইন থেকে ফিরেছেন। তাদের পরিচয় গোপন এ প্রতিবেদন লিখেছে বিবিসি।
এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত নামগুলো ছদ্মনাম।
ইউক্রেনের এই সেনারা ভয়াবহ বৈরী আবহাওয়া ও ঘুমের ঘাটতির কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন রাশিয়ার অবিরাম বোমাবর্ষণের কথা। বিশেষ করে ৩ হাজার কেজি ওজনের গ্লাইড বোমা তাদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
কুর্স্ক অঞ্চলে তারা পিছু হটছেন। রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে ফের এ অঞ্চলের দখল নিচ্ছে।
পাভলো নামে এক সৈনিক ২৬ নভেম্বর এক বার্তায় বলেন, 'এই ধারা চলতেই থাকবে। এটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার।'
পাভলো জানান, সেনারা চরম ক্লান্তিতে ভুগছেন। এখানকার সেনারা অধিকাংশই মধ্যবয়সি পুরুষ। অন্য ফ্রন্ট থেকে সরাসরি এনে তাদের এখানে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমিক বিশ্রামের কোনো সুযোগ ছাড়াই তারা লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে। এতে ক্লান্তি আর হতাশা দিন দিন বাড়ছে।
কমান্ডিং অফিসারদের ভূমিকা, আদেশের অসংগতি ও সরঞ্জামের ঘাটতি নিয়ে সেনারা নিয়মিতই অভিযোগ করছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি কঠিন হলে অবশ্য এমন অভিযোগ আসা সাধারণ ঘটনাই।
একদিকে শীত ঘনিয়ে আসছে, অন্যদিকে ক্রমেই বাড়ছে শত্রুর চাপ। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের মধ্যে হতাশা জেঁকে বসছে।
বিবিসি যেসব বার্তা পেয়েছে, তার প্রায় সবই হতাশায় ভরা। এসব বার্তা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এই অভিযান চালানোর মূল উদ্দেশ্য—রাশিয়ার সৈন্যদের ইউক্রেনের পূর্ব ফ্রন্ট থেকে সরিয়ে নেওয়া—আসলে কতটা সফল হয়েছে।
ইউক্রেনীয় সেনারা জানান, এখন তাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে জানুয়ারির শেষদিকে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণের আগপর্যন্ত কুর্স্কের এই ছোট্ট এলাকার 'মাটি কামড়ে' পড়ে থাকা।
পাভলো বলেন, 'আমাদের মূল কাজ হলো ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ এবং আলোচন শুরুর আগপর্যন্ত যতটা সম্ভব এলাকা ধরে রাখা। যাতে পরে এটা দরকষাকষিতে কাজে আসে।'
নভেম্বরের শেষদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, উভয় পক্ষই মার্কিন প্রশাসনের পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে আছে।
তিনি বলেন, 'আমি নিশ্চিত, তিনি [পুতিন] আমাদের ২০ জানুয়ারির মধ্যে সরাতে চান। তিনি যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেটি দেখানো তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আদতে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন না।'
কুর্স্কে রুশ বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স রাশিয়ার অভ্যন্তরে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ইউক্রেনকে।
কিন্তু এতে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের মনোবল খুব বেশি বাড়ছে না।
পাভলো বলেন, 'হিমশীতল পরিখায় বসে কেউ ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য প্রার্থনা করে না। আমরা এখানে বসে লড়াই করি। আর ক্ষেপণাস্ত্র অন্য কোথাও উড়ে যায়।'
এটিএসিএমএস ও স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র দূরবর্তী কমান্ড পোস্ট ও গোলাবারুদের ভান্ডারে শক্তিশালী আঘাত করেছে বটে। কিন্তু ফ্রন্টলাইনের সৈন্যদের কাছে এই সাফল্য বহু দূরের বিষয়।
আরেক সৈনিক মিরোস্লাভ বলেন, 'আমরা মিসাইল নিয়ে আলোচনা করি না। বাঙ্কারে আমরা পরিবার আর বিশ্রাম নিয়ে কথা বলি। সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।'
পূর্বাঞ্চলে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়া। এর ফলে ইউক্রেনের জন্য কুর্স্কের দখল ধরে রাখা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
শুধু অক্টোবরেই ইউক্রেনের প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর পর আর যেকোনো একক মাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অঞ্চল দখলের রেকর্ড এটি।
অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই আগস্টে দখল করা কুর্স্কের প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা হারিয়েছে ইউক্রেন।
ভাদিম বলেন, 'আসল ব্যাপার দখল করা নয়, দখল ধরে রাখা। এই জায়গায় আমরা কিছুটা সমস্যায় আছি।' তবে এসব ক্ষতির পরও ভাদিম মনে করেন, কুরস্ক অভিযান এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
'এ অভিযান জাপোরিঝঝিয়া ও খারকিভ অঞ্চল থেকে [রুশ] বাহিনীকে কিছুটা সরিয়ে আনতে পেরেছে,' বলেন তিনি।
তবে বিবিসির সঙ্গে কথা বলা কিছু সেনা মনে করছেন, তারা ভুল জায়গায় আছেন। তাদের মতে, রাশিয়ার এলাকা দখল করার চেয়ে ইউক্রেনের পূর্ব ফ্রন্টে থাকা বেশি জরুরি ছিল।
পাভলো বলেন, 'আমাদের থাকা উচিত ছিল সেখানে [পূর্ব ইউক্রেনে], এখানে নয়। অন্যের ভূখণ্ডে নয়। কুর্স্কের এই বনভূমি আমাদের দরকার নেই। এখানে আমরা বহু সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি।'
সম্প্রতি ১০ হাজার উত্তর কোরীয় সৈন্য রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে কুর্স্কে আসার খবর পাওয়া গেছে। তবে যেসব ইউক্রেনীয় সেনার সঙ্গে বিবিসির কথা হয়েছে, তারা কোনো কোরীয় সৈন্য দেখেননি বলে জানান।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অবশ্য উত্তর কোরীয় রেডিও যোগাযোগের কথোপকথন শনাক্ত করার দাবি করেছে।
ইউক্রেনীয় সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অন্তত একজন উত্তর কোরীয়কে বন্দি করতে, বিশেষত পরিচয়পত্রসহ। কেউ এ কাজে সফল হলে ড্রোন বা অতিরিক্ত ছুটির মতো পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে পাভলো ঠাট্টার সুরে বলেন, 'কুর্স্কের অন্ধকার বনভূমিতে কোনো কোরিয়ানকে খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন। বিশেষ করে সে যদি এখানে না থাকে।'
কুর্স্কের পরিস্থিতির সঙ্গে আগের কিছু ব্যর্থ অভিযানের তুলনা টেনেছেন অভিজ্ঞ সৈন্যরা।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বাহিনী নিপ্রো নদীর বাম তীরে, খেরসনের প্রায় ২৫ মাইল উজানে, ক্রিনকি অঞ্চলে একটি ছোট জায়গার দখল ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল।
শুরুর দিকে পরিকল্পনা ছিল, এ অঞ্চল দিয়ে রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের দিকে এগোনো হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এলাকাটির দখল হারাতে হয়।
ওই অভিযানে ব্যাপক ক্ষতি হয় ইউক্রেনের। ধারণা করা হয়, প্রায় ১ হাজার ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত বা নিখোঁজ হয়েছেন।
অনেক ইউক্রেনীয় সৈন্যই মনে করেন, যুদ্ধের ময়দানে অন্যান্য জায়গার অগ্রগতি না হওয়ায় মনোযোগ সরাতে 'স্টান্টবাজি' হিসেবে এ অভিযান চালানো হয়েছিল।
তাদের আশঙ্কা, কুর্স্কেও একই পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।
ক্রিনকি অভিযানে ছিলেন মিরোস্লাভ, এখন আছেন কুর্স্কে। তিনি বলেন, 'আইডিয়াটা ভালো ছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন ছিল খারাপ। মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছে, কিন্তু কোনো সামরিক সাফল্য আসেনি।'
তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকট সত্ত্বেও কুর্স্ক অভিযান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইউক্রেনিয়ান সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন সেন্টারের সেরহি কুজান বলেন, 'একমাত্র এই এলাকাতেই আমরা এখনও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছি।'
তিনি স্বীকার করেন, কুর্স্কে ইউক্রেনীয় বাহিনী 'অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন পরিস্থিতির' মুখোমুখি। তবে এ-ও বলেন, রাশিয়া তাদের এখান থেকে সরাতে এত পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করছে, যা অন্য ফ্রন্টে ব্যবহার করা যেত।
এই সমর বিশেষজ্ঞের মতে, 'আমরা যত বেশিদিন কুর্স্ক ফ্রন্ট ধরে রাখতে পারব—পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, গোলাবারুদ, হিমার্স ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে—ততই ভালো।'
কিয়েভের শীর্ষ কমান্ডাররা কুর্স্ক অভিযানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তাদের দাবি, এটি এখনও সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে সুফল দিচ্ছে।
একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এই পরিস্থিতি পুতিনকে ক্ষুব্ধ করছে। তিনি সেখানে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।'
কুর্স্কে ইউক্রেনীয় বাহিনী কতদিন টিকে থাকতে পারবে—এই প্রশ্নের উত্তরে এল সরাসরি: 'যতদিন সামরিকভাবে সম্ভব।'