৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৩০০ কোটি পাখি!
গত বেশ কিছু দশক ধরেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে পাখিদের বিভিন্ন প্রজাতি, বিলুপ্তও হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির পাখি। কিন্তু ঠিক কি পরিমাণ পাখি হারিয়ে গেছে তার কোন হিসেব করা হয় নি এতদিন।
অবশেষে বেরিয়ে এল এক পরিসংখ্যান! ‘সায়েন্স এন্ড বায়োলজিকাল কনজারভেশন’ নামে বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিষয়ক এক জার্নালে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই গবেষণার পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫০ বছরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে ৩ বিলিয়ন মানে, ৩০০ কোটি পাখি! প্রতি ৩ টি পাখির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১ টি।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পাখি বিলুপ্তি ঘটেছে এশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হারিয়ে গেছে ৩০ শতাংশ পাখি।
আমেরিকার পাখি সংরক্ষণ সংস্থা ও করনেল ল্যাবের বিজ্ঞানী ড. কেন রসেনবার্গ ছিলেন এই গবেষণার প্রধান গবেষক। এছাড়াও ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী মার্শাল, ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী পিটার মারা প্রমুখ এই গবেষণা পরিচালনায় অংশ নেন।
৩০০ কোটি পাখি কি করে হারিয়ে গেল?
উত্তর আমেরিকার পাখিদের নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, মানুষের কর্মকাণ্ডই পাখিদের এই বিলুপ্তির জন্য দায়ী।
এই গবেষণার প্রধান গবেষক ড. কেন রসেনবার্গ বলেন, "এই প্রথম পাখির সংখ্যা নিয়ে এত ব্যাপক পর্যায়ে কোন জরিপ করা হলো।"
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারছিলাম কিছু কিছু বিরল প্রজাতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সচরাচর যে পাখিগুলো আমরা দেখতে পাই লোকালয়ে, যেমন- মিডোলার্ক, আমেরিকান চড়ুই - এরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে অভ্যস্ত। মানুষের জীবন ধারণের নাগরিক পরিবেশের সঙ্গে এরা খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সুতরাং এরা সহজে হারিয়ে যাবে না বলেই ভেবেছিলাম আমরা।"
“কিন্তু ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫০ বছরের পাখি জনগোষ্ঠী নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে আমরা দেখতে পেলাম, এই সাধারণ পাখিগুলোও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।”
উত্তর আমেরিকা আর কানাডায় পাখি গণনার জন্য, তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাঁরা এক অদ্ভুত পদ্ধতি অনুসরণ করেন- আবহাওয়ার রাডার। মেঘের গতিবিধি আর বাতাস ছাড়াও ভারী কোন বস্তুর যাতায়াতও রাডারে ধরা পড়ে। এখান থেকে মেঘ আর বাতাসের হিসেবটা বাদ দিয়ে পাখির গতিবিধির হিসেব রাখেন তারা। এই পরিসংখ্যান থেকে তারা দেখতে পেলেন ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাখির পরিমাণ কমে গেছে ১৪ শতাংশ।
গবেষণার পরিচালনা করতে গিয়ে তারা দেখতে পেলেন, ৫২৯ টি প্রজাতির পাখি জনগোষ্ঠী কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, বন-জঙ্গল ধ্বংস করা এর অন্যতম কারণ। বনাঞ্চল না থাকার মানে হলো পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর এক অঞ্চলের পাখি চাইলেও ভিন্ন জলবায়ুর কোন দেশে উড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে না। ফলে অবধারিতভাবেই মারা যাচ্ছে এই পাখিরা।
এছাড়াও উত্তর আমেরিকায় প্রতি বছর বিড়াল খেয়ে ফেলছে কয়েক কোটি পাখি। দ্রুতগতির গাড়ির উইন্ডশিল্ড ও বহুতল ভবনের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও প্রতি বছর অনেক পাখি মারা পড়ে।
একইভাবে বিশ্বের অন্য অংশগুলোতেও পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। এশিয়া থেকে কি করে এত পাখি হারিয়ে গেল তার কারণও উঠে এসেছে গবেষণায়। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ায় যা হচ্ছে, তা রীতিমতো হতবাক করে দেয়ার মতো।
গায়ক পাখির ব্যবসা
এশিয়ায় পাখি বিলুপ্ত হবার অন্যতম কারণ পাখি ব্যবসা। গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে একটি বিশাল অঙ্কের পাখি হারিয়ে গেছে। কারণ হিসেবে গবেষকরা দেখতে পেলেন, সেখানে গায়ক পাখিদের খাঁচায় পুরে রাখা হয় তাদের সুরেলা কণ্ঠের জন্য। জাভা দ্বীপে অরণ্যের চেয়ে এখন খাঁচায় বন্দী পাখির সংখ্যাই বেশি।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. রসেনবার্গ বলেন, ২০১৭ সালে এই ব্যবসা নিয়ে আমরা এক জরিপ পরিচালনা করেছিলাম। সেই জরিপে দেখা গেছে, ১২ টিরও বেশি প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুধুমাত্র এই পাখি ব্যবসার কারণে।
না, শুধু খাঁচায় পুরে পোষা হয় না তাদের। তবে কি করা হয় ভাবছেন? জাভায় প্রতি বছর এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেখানে বিচারকদের সামনে পাখিরা গান গায়, ডাকে। পাখির গানের এই প্রতিযোগিতাকে বলা হয় ‘কিকাউ-ম্যানিয়া’। এই প্রতিযোগিতায় সবচাইতে সুরেলা কন্ঠের পাখি হয় বিজয়ী, যে তার মালিককে এনে দিতে পারে ৪০ হাজার পাউন্ডেরও বেশি।
পাখি ধরার এই সংস্কৃতিই পাখির প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
এই গবেষণার আরেক প্রধান গবেষক হ্যারি মার্শাল বলেন, “শত শত মিলিয়ন ডলারের এই ব্যবসা ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির জন্য রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর চাহিদাও ব্যাপক। আর চাহিদার যোগান দিতেই দিন দিন পাখি ধরে বাজারে বিক্রির প্রবণতা বেড়ে চলেছে। সেখানে শত শত পাখির বাজারে নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে ২০০’র বেশি প্রজাতির পাখি।
এই গবেষণার আরেক প্রধান গবেষক ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী মার্শাল। এই গবেষণার জন্য জাভা দ্বীপের পাখিদের নিয়ে জরিপ পরিচালনা করেন মার্শাল। জরিপের কাজে জাভা দ্বীপের ৩ হাজার বাড়িতে গিয়ে তিনি পেলেন এক অভাবনীয় তথ্য। এই ৩ হাজার বাড়িতে তিনি দেখতে পেলেন ৭৫ মিলিয়ন , মানে সাড়ে ৭ কোটি খাঁচায় বন্দী পাখি!
তিনি ধারণা করছেন, জাভা দ্বীপে এখন বনের পাখির চেয়ে খাঁচায় বন্দী পাখির সংখ্যা বেশি।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি করা যেতে পারে?
বিজ্ঞানীরা এখনও আশার আলো দেখছেন। তারা আশা করছেন, এই ফলাফল হয়তো আমাদের টনক নড়াবে, হয়তো আমরা মানুষেরা কিছুটা হলেও সচেতন হবো।
তারা মনে করছেন, আমরা চাইলে এখনও এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।
ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী পিটার মারা বলেন, ‘৩০০ কোটি পাখি! সংখ্যাটা ধাক্কা দেয়ার মতো। আমাদের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে আছে। এখনই সময় সচেতন হবার।’
ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর স্টুয়ার্ট মার্সডেন বিবিসিকে বলেন, “এই যে এত পাখি ধরে রাখছে মানুষ, এর কারণ তারা পাখি ভালোবাসে। এখন পাখির প্রতি এই ভালোবাসাকে যদি ইতিবাচক দিকে কাজে লাগানো যায়, সুন্দর আগামীর দিকে বইয়ে দেয়া যায়, তবেই এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।”
উদাহরণ হিসেবে ড. রসেনবার্গ বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় হাঁস শিকারীরা একসময় লক্ষ্য করলেন যে জলজ পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পরে তারা মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করলেন জলাভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য।
এটাই একটা মডেল হতে পারে। এভাবে একদিন পাখি প্রেমীরাই রক্ষা করবেন পাখিদের।
কিন্তু শুধু পাখি প্রেমীরাই নয়, সময় হয়েছে আমাদের সকলের এগিয়ে আসার। আমরা সবাই মিলে যদি সচেতন হই, কাজ করি, নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিই - তবে একদিন নিশ্চয়ই পরিস্থিতি পালটে যাবে। আবার পাখিদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে জাভা দ্বীপের অরণ্য। খাঁচায় নয়, মুক্ত আকাশেই উড়ে বেড়াবে তারা।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, রয়টার্স এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম