অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হলে সংকটে পড়বে জাহাজভাঙা ও ইস্পাত শিল্প
শিল্প খাতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ফলে জাহাজভাঙা ও ইস্পাত শিল্পের উৎপাদন সরাসরি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সংকটে পড়তে যাচ্ছে অটোমোবাইল ও কনস্ট্রাকশনসহ কয়েকটি খাত।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে বন্ধ হয়ে যাবে ইস্পাত ও রি-রোলিং মিলগুলো। রডের দাম বেড়ে ব্যাহত হবে আবাসন ও কনস্ট্রাকশন কার্যক্রম। অন্যদিকে, চেসিস ও পার্টস সংযোজনে অক্সিজেনের ব্যবহার থাকায় সংকটে পড়তে পারে এ শিল্পও। এর ফলে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ শ্রমিকের পেশাগুলো হুমকিতে পড়বে।
নির্মাণ খাতের অপরিহার্য সামগ্রী রড। রডে দেশের চাহিদার পুরোটাই পূরণ করেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। উৎপাদকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রড উৎপাদনে ওয়েল্ডিং সেকশনে অক্সিজেনের ব্যবহার করতে হয়। এটি না হলে মেশিন আটকে যায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়।
শিল্প মালিকরা বলছেন, দেশে ছোট বড় মিলিয়ে চার শতাধিক রি-রোলিং মিল রয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ ব্র্যান্ড রয়েছে ২০টিরও বেশি। এসব কারখানায় বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি রড উৎপাদন হয়। অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তবে কারখানার বিদ্যমান স্টক অক্সিজেনে ১০-২৫ দিন পর্যন্ত কেউ কেউ উৎপাদন চালিয়ে নিতে পারবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিংস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সেক্রেটারি জেনারেল শহিদুল্লাহ।
তিনি বলেন, 'ইস্পাত শিল্পের উৎপাদনে হ্যাম্পার ঘটবে। স্টিল উৎপাদনের সময় মেশিনের অনেক সেকশন আটকে যায়। ওয়েল্ডিংয়ের সময় ওয়াশিংয়ে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। প্রতিটি স্টেজ অতিক্রম করার জন্য অক্সিজেন দরকার হয়। যাদের স্টক জমা নেই, তাদের প্রডাকশন এখনই বন্ধ হবে।'
অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের জাহাজভাঙা শিল্প। শিল্প মালিকরা বলছেন, ২ লাখের বেশি কর্মসংস্থানের এ শিল্পের কাজের অনেক অংশই নির্ভর করে অক্সিজেনের ওপর।
জাহাজের বড় বড় লৌহ খণ্ড ক্রাশিংয়ে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হয়।
শিল্প মালিকরা বলছেন, অক্সিজেন না পেলে অধিকাংশের পক্ষেই একদিনও কাজ চালানো সম্ভব নয়। তবে নিজেদের অক্সিজের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ অব্যাহত রাখতে পারবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস অ্যান্ড রিসাইকেলারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. আবু তাহের বলেন, 'আমাদের নিজেদের অক্সিজেন কারখানা রয়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আমরা অন্য ইয়ার্ডেও তা বিক্রি করি। আমাদের এ বিক্রি এখনো অব্যাহত রয়েছে।'
জাহাজভাঙা শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সম্ভাবনাময় শিল্প। 'রিভিউ অব ম্যারিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২০' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৪.৭ শতাংশ জাহাজ রিসাইকেল করে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের উত্তর উপকূল ধরে প্রায় ১২০টি জাহাজভাঙার ইয়ার্ড রয়েছে। এসব ইয়ার্ডে কাজ করেন অন্তত ২ লাখ মানুষ। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে সরকারকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব প্রদান করছে বলেও দাবি তাদের।
অন্যদিকে, দেশের ইস্পাত কারখানাগুলোর মোট কাঁচামালের ৭০ শতাংশই যোগান দেয় জাহাজভাঙা শিল্প। এখান থেকে বের হওয়া ইস্পাতই তাদের মূল উৎস।
জাহাজভাঙা শিল্প এবং ইস্পাতের মতোই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের আরেক বৃহৎ ব্যবহার খাত অটোমোবাইল ও গাড়ির ওয়ার্কশপ। গাড়ির চেসিস-সহ বিভিন্ন পার্টস সংযোজন ও মেরামতে ওয়েল্ডিংয়ে অক্সিজেনের ব্যবহার করতে হয়।
অটোমোবাইল ও ওয়ার্কশপ সেক্টরে কাজ করেন কয়েক লাখ কর্মী।
বাংলাদেশে চলতি এপ্রিল মাসের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। ভারতও অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে শিল্প কারখানার অক্সিজেন আপাতত বন্ধ রাখার নিদের্শনা দিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর।
দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ অক্সিজেন ভারত থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে মেডিকেল ও শিল্প মিলিয়ে দেশে অক্সিজেনের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ২২০-২৫০ টন। এর মধ্যে মেডিকেল অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা ১০০-১২০ টন। নতুন নিদের্শনার ফলে মোট উৎপাদনের পুরোটাই ব্যবহৃত মেডিকেলের জন্য। তবে বর্তমানে মেডিকেলে চাহিদা ১৫০ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন বলেন, 'সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কায় দৈনিক অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টনে। রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমায় এখন হাসপাতালগুলোতে ১৪০ থেকে ১৫০ টনের মতো অক্সিজেন লাগছে।'
দেশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেকের যোগান দেয় লিন্ডে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা এরইমধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সরবরাহ বন্ধ করে হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্ট দিচ্ছি। বর্তমানে দৈনিক ৯০-১০০ টন অক্সিজেন হাসপাতালে দিতে হচ্ছে।'
বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যে ১৩ এপ্রিল বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বেড়েছিল। ২১ এপ্রিল আমদানি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে চারটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন আমদানি করে।