আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত, বনের জমি ইজারা পেল জাহাজভাঙা কারখানা
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বন উজার করে জাহাজভাঙা কারখানা স্থাপনের ঘটনায় অভিযুক্ত কোহিনূর স্টিলকে ইজারা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে দুবার ইজারা বাতিল হওয়ার পরও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের আদেশে তা ফিরে পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।
ইজারা বাতিলের বিরুদ্ধে কোহিনূর স্টিলের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম প্রকাশ ওরফে রাজা কাশেম বিভাগীয় কমিশনার বরাবর আপিল করলে গত ২৪ মার্চ ইজারা পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কাগজপত্র যথাযথ পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই শেষে কোহিনূর স্টিলের ইজারা পুনর্বহাল করা হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ২৯ মে কোহিনূর স্টিলের ইয়ার্ডে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন। পরে ১ জুন ইজারা বাতিল করা হয়।
বন বিভাগ ও পরিবেশ সংস্থাগুলো জমি ইজারা দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। তারা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলের বাইরে ও শিল্পাঞ্চলের ভেতরে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানের মিথ্যা দাবি করে ইজারা নেওয়া হয়েছে।
তবে কোহিনূর স্টিলের মালিক আবুল কাশেম অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে সাম্প্রতিক ইজারা তার প্রতিষ্ঠানের বৈধতা প্রমাণ করে।
তিনি টিবিএসকে বলেছেন, "কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। প্রয়োজনীয় সকল অনুমতি নিয়েছি।"
তিনি আরো বলেন, "এরপরও কুচক্রিমহল ষড়যন্ত্র করেছে। বিধি মোতাবেক কাজ করায় আমি আদালত থেকে রায় পেয়েছি।"
এলাকাটিতে সাম্প্রতিক পরিদর্শনের সময় টিবিএস পর্যবেক্ষণ করেছে, জাহাজভাঙার কার্যক্রমের জন্য জমি প্রস্তুত করা হচ্ছে। মাটি ভরাট করার পাশাপাশি ইয়ার্ডের দোতলা ভবনটি মেরামত করা হয়েছে। পূর্বে ইয়ার্ডের উত্তর দিকে গাছপালা থাকলেও বর্তমানে তা একেবারেই নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী হাসানুল বান্না টিবিএসকে বলেছেন, ১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে এই উপকূলীয় জমিতে বনায়নের প্রচেষ্টা চলছে।
বন রক্ষায় জমিগুলো বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এলাকাটি সংরক্ষিত বনের মর্যাদা পাবে।
তিনি আরো বলেন, "২০১৯ সালে আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ ধরনের কার্যক্রম চলাকালীন কোনও ইজারা দেওয়া উচিত নয়। জেলা প্রশাসনকে জমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ইজারা মঞ্জুর করায় এ অঞ্চলের বন উজার হয়েছে।"
উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেছেন, উপকূলীয় বনের জমিগুলো এখনো ভূমি মন্ত্রণালয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। এমন অবস্থায় এসব জমি ইজারা দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, "এ জমিতে পূর্বে উপকূলীয় বন ছিল। আমরা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
জমি ইজারার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর সলিমপুর মৌজার ২১ দশমিক ৫৭ একর জমি ইজারার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিল আবুল কাশেমের আরেকটি কোম্পানি বিবিসি স্টিল।
এর প্রেক্ষিতে ঐ মাসেই সরেজমিনে তদন্ত করেছিলেন সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসের একটি দল। সীতাকুণ্ড ভূমি অফিস দেখতে পায়, জমিটি উত্তর সলিমপুরের পশ্চিমে এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর জাহাজ ভাঙা শিল্পাঞ্চলের বাইরে অবস্থিত তুলাতলী মৌজার অংশ।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তুলাতলী মৌজাসহ নির্ধারিত জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চলের বাইরে উপকূলীয় জমিতে কোনো ইয়ার্ড স্থাপন করা যাবে না।
পরের বছর পরিদর্শন প্রতিবেদন সত্ত্বেও বিবিসি স্টিলকে আবার তুলাতলী মৌজায় ৭.১০ একর জমি দেওয়া হয়।
বন বিভাগের এতে আপত্তি ছিল কারণ ইজারা দেয়া জমিটি জাহাজভাঙার জন্য মনোনীত বিশেষ অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল না।
এছাড়া ইজারা বাতিলের জন্য উচ্চ আদালতে জনস্বার্থ মামলা করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
২০২০ সালের ২ জানুয়ারি উচ্চ আদালত ইজারা প্রক্রিয়াটিকে অননুমোদিত ঘোষণা করেন এবং জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে বনভূমি রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
ইজারা বাতিলে পর ২০২০ সালে ১০ একর ভূমির জন্য আবারো আবেদন করে বিবিসি স্টিলের মালিক রাজা কাশেমের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কোহিনূর স্টিল। এর প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সীতাকুণ্ড উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম ইজারা প্রদানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বনের জমি উচ্চ আদালতের সংরক্ষণের বিষয়টি সামনে আনেন। পরে তারা দুজনই বদলি হয়ে যান।
২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও কোহিনূর স্টিলকে ৫ একর জমি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, ওইসময় ইজারাকৃত জমিগুলোকে জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য ঘোষিত জোনভুক্ত উত্তর ছলিমপুর দেখানো হলেও বেশিরভাগ জমি ছিল তুলাতলী মৌজার।
নতুন করে বনের জায়গা ইজারা দেওয়ায় ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, কোহিনূর স্টিলসহ বিভিন্ন পক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়েছিল বেলা। একই জায়গা নতুন করে ইজারা দেওয়ায় বেলা আদালত অবমাননার আবেদন জানায়।
এরপর উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ২০২৩ সালের জুনে দ্বিতীয় দফায় ইজারা বাতিল করে জেলা প্রশাসন। ইজারা বাতিলের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়।
তখন জেলা প্রশাসনের নথিতে ইজারা বাতিলের কারণ হিসেবে কোহিনূর স্টিল ইয়ার্ডের জমিকে তুলাতলী মৌজার (শিল্পজোন বহির্ভূত) উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, ইজারাদার গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করেছেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে জমি দখল করে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
বেলার আইনজীবী হাসানুল বান্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে দুই দফায় ইজারা বাতিল হয়েছে। উচ্ছেদও হয়েছিল। এরপরও একই জমির ইজারা পুনর্বহাল করা উচ্চ আদালত অবমাননার শামিল। আমরা আবারো আদালতের শরণাপন্ন হবো।"