অষ্টগ্রামের পনিরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অপার সম্ভাবনা
- প্রতিদিন গড়ে দেড়শ কেজি পনির বাজারজাত হয় অষ্টগ্রাম থেকে।
- মাসে পনির বিক্রি হয় ৩০ লাখ টাকারও বেশি।
- করোনাভাইরাসের প্রভাবে পনিরের ব্যবসা কমেছে ২৫ শতাংশ।
কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত অষ্টগ্রাম উপজেলার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ খাবার পনির। মুঘল শাসনামল থেকে তৈরি হয়ে আসা পনির এখন অষ্টগ্রামের ঐতিহ্য। আর বংশ পরম্পরায় এ ঐতিহ্য এখনও লালন করছে ১২-১৫টি পরিবার। এদের মধ্যে পুঁজির সংকটের কারণে কেউ কেউ পনির ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াতে চাইছেন। বিদেশে চাহিদা বিবেচনায় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এই খাবার রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়েছেন পনির তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে প্রতিদিন ১ লাখ টাকারও বেশি মূল্যের পনির বিক্রি হয় অষ্টগ্রাম থেকে। আর মাসে বিক্রি হয় ৩০ লাখ টাকারও বেশি। অষ্টগ্রামের পনির ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুঘল শাসনামলে অষ্টগ্রামে প্রথম পনির তৈরি শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে পনির তৈরি ও বাজারজাতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ (অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনের সাবেক সংসদ সদস্য) এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় অষ্টগ্রামের পনিরের সুনাম করায় সমগ্র দেশে পরিচিতি পায় এখানকার পনির। বর্তমানে অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যঅষ্টগ্রাম, আলম দীঘিরপাড় ও মাইজেরহাঁটি গ্রামে পনির তৈরি হচ্ছে।
তিন গ্রামের ১২-১৫টি পরিবার বংশ পরম্পরায় বাণিজ্যিকভাবে পনির তৈরি ও বাজারজাত করে আসছে। পরিবারের সকল সদস্যরা মিলেই তৈরি করেন পনির। গরুর খাঁটি দুধে তৈরি এ পনির খেতে অনেক সুস্বাদু হওয়ায় এর কদর সর্বত্র। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্যও বঙ্গবভন এবং গণভবনে যায় এখানকার পনির।
তবে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পনির ব্যবসা অন্তত ২৫ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অদৃশ্য এ ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে একেকটি পরিবার প্রতিদিন ১২-১৫ কেজি পনির বাজারজাত করতে পারত। কিন্তু এখন দৈনিক ৮-১০ কেজি বাজারজাত হচ্ছে। এক কেজি পনির তৈরিতে ১০ কেজি দুধ লাগে এবং খরচ পড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতি কেজি পনির বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে। খরচ এবং পনির তৈরিতে পরিশ্রমের তুলনায় লাভ কম হওয়ায় অনেকেই পুরনো এই ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে চাইছেন।
যেভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু পনির
প্রথমে একটি বড় ডেকচিতে কাঁচা দুধ রাখা হয়। এরপর দুধ জমাট বাধার জন্য পরিমাণমতো ভিনেগার ঢালা হয়। আধা ঘণ্টা লাগে দুধ জমাট বাধতে। এরপর হাত দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে দুধের জমাট ভাঙা হয়। এভাবে কিছুক্ষণ নাড়ার পর দুধ ছানা হয়ে যায়। পরবর্তীতে ছানাগুলো পানি থেকে আলাদা করে ছোট ছোট টুকরিতে রাখা হয় পানি ছাঁকার জন্য। এভাবে পানি ছাঁকার পর পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু পনির।
পনির ব্যবসাকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করতে পুঁজি প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন এর সঙ্গে যুক্তরা। এছাড়াও তারা বিদেশে পনির রপ্তানি করতে চান। এতে করে পনির ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি দেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে বিদেশে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হবে।
মধ্যঅষ্টগ্রামের পনির ব্যবসায়ী ফিরোজ মিয়া বলেন, 'পনির ব্যবসাটি আমাদের পূর্বপুরুষের বলেই এখনও করছি। কিন্তু আমাদের পুঁজির অভাব রয়েছে। টাকার জন্য ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছিনা। এছাড়া ব্যবসায় লাভও কম। সেজন্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বেশিদিন ব্যবসা চালানো সম্ভব হবে না'।
বংশ পরম্পরায় পনিরের ব্যবসা করা এস. এম. নিশান বলেন, 'বংশ পরম্পরায় আমাদের পরিবারের মধ্যে আমি এখন এ ব্যবসা করছি। পনির বিক্রি করেই আমার পরিবার চলে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা কিছুটা কমেছে। আগে গড়ে প্রতিদিন ১৫ কেজি পনির বিক্রি করতে পারতাম। এখন বিক্রি করছি ১০ কেজির মতো'।
'রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য বঙ্গভবন ও গণভবনেও আমাদের তৈরিকৃত পনির নেওয়া হয়। আমরা চাই আমাদের ব্যবসাকে আরও বড় করতে। বিদেশে যদি রপ্তানির সুযোগ পাই, তাহলে আমরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের সুনাম বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন পথ তৈরি হবে', উল্লেখ করেন নিশান।
আরেক ব্যবসায়ী মো. সেলিম রেজা বলেন, 'পনিরের জন্য প্রচুর দুধ লাগে। দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য নিজেদের দুগ্ধ খামার করা প্রয়োজন। কিন্তু পুঁজির অভাবে সেটি আমরা করতে পারছিনা। যদি আমাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়, তাহলে আমরা এই পনির ব্যবসা আরও বড় করতে পারব'।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রফিকুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পনির ব্যবসায় যুক্তদের স্থানীয়ভাবে যে ধরনের সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব, সে সহযোগিতা আমরা করব। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পনির ব্যবসায়ীদের সকল সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। তবে বিদেশে পনির রপ্তানির বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলতে পারবে। এ সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই'।