সিলেটে বন্যা: ফের আলোচনায় কিশোরগঞ্জের সেই ‘অলওয়েদার সড়ক’
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট অঞ্চলে বন্যা হলেই কিশোরগঞ্জের একটি সড়ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। চলতি বছরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বন্যায় আক্রান্ত সিলেট। এর আগে ২০২২ সালে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা হয়। এতে পুরো বিভাগের প্রায় ৭০ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যায়।
সিলেটে সাম্প্রতিক ঘনঘন বন্যার জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত 'অলওয়েদার সড়ক' নামে পরিচিত ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন অনেকে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সিলেটের বন্যার জন্য এই সড়ককে দায়ী করছেন।
তাদের দাবি, সিলেটে আগেও এরকম প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু এমন বন্যা হতো না। এখন কিশোরগঞ্জের এই সড়কটির কারণে সিলেটের বৃষ্টি ও ঢলের পানি হাওর দিয়ে নদীতে নামতে পারছে না। ফলে পানি আটকে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আলোচিত এই সড়কটি নির্মিত হয় ২০২০ সালে। হাওরের তিন উপজেলার যোগাযোগ সহজতর করার পাশাপাশি এই সড়কটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়।
২০২২ সালে সিলেটের বন্যার পরও আলোচনায় উঠে আসে এই সড়কটি। তখন মন্ত্রীসভায়ও আলোচনা হয়েছে এই সড়ক নিয়ে। হাওরের বন্যায় এই সড়কের কোন প্রভাব রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে বলে মন্ত্রীসভা।
এরপর পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, "কিশোরগঞ্জের এই সড়কটি সিলেট বন্যার কারণ বলে মনে হয় না। এখনও সেই সড়কের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে হাওরে এই ধরনের সড়ক নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাব তো রয়েছেই। ভবিষ্যতে এই প্রভাব পড়তে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "এই সড়কের কারণে কয়েক বছর পর ওই এলাকার হাওর ও বিল ভরাট হয়ে যেতে পারে। তখন সিলেট অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। সিলেট শহর রক্ষার জন্য নদীর তীরে বাঁধ প্রয়োজন।"
হাওরে সড়ক নির্মাণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, "হাওরে সড়ক হলে তো সেখানকার পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবেই। শুধু কিশোরগঞ্জের সড়কই না হাওর এলাকায় যত্রতত্রভাবে সড়ক নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রহস্থ হচ্ছে। হাওরের জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "হাওরে সড়ক হবে কেন? সড়ক পথের চেয়ে ওই এলাকায় নৌ চলাচলকে আধুনিক ও উন্নত করা প্রয়োজন।"
সিলেটের বন্যার জন্য ইটা-মিঠামইন সড়ক প্রধান কারণ নয় বলে মনে করেন পরিবেশ কর্মী হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, "ইটনা-মিঠামইন বহু দূরের গল্প। আগে সিলেট নগর, ছাতক শহর, সুনামগঞ্জ শহরের পানি আদৌ সুরমা নদী পর্যন্ত যেতে পারছে কি-না এবং যেতে পারলে সেই নদীগুলো অতিরিক্ত পানি ধারণে সক্ষম আছে কি-না সেটা নিশ্চিত করা গেলে পর দেখা যেতে পারে আদৌ ঐখানে পানি আটকায় কি-না।"
তিনি বলেন, "মূল বিষয় বাদ দিয়ে ইটনা-মিঠামইনের সড়ককেই সিলেট সুনামগঞ্জের বন্যার প্রধান কারণ বানিয়ে দেয়া অন্ধের হাতীদর্শনের পুরোনো গল্পের মতো ঘটনা।"
ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নামা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওর হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। অলওয়েদার সড়কের অবস্থানও কিশোরগঞ্জে।
কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসিগার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে।
বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, সিলেটের পানি দুই-তিনটি নদী দিয়ে নামে। একটি হলো সুরমা ও পুরাতন সুরমা হয়ে নামে ধনু দিয়ে। সুনামগঞ্জের পানিও এই নদী দিয়ে নামে। নদীটির অবস্থান অলওয়েদার সড়কের সমান্তরালে। সিলেট অঞ্চলের আরেক নদী কুশিয়ারা হাওরে এসে হয়েছে কালিনী নদী। এটি সড়কের আরেক পাশ দিয়ে নামে। ফলে অল ওয়েদার সড়ক পানি নামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নিতেশ বড়ুয়া বলেন, "সড়কে পানি যাওয়ার জন্য অনেক সেতু আছে। তাছাড়া এই সড়কের কারণে পানি আটকে থাকলে তো সড়কের আশপাশ এখন পানিতে টইটুম্বুর থাকতো। এমনটিও নেই।"
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. মো. খালেকুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানিপ্রবাহের সুযোগ রাখা হয়।"
খালেকুজ্জামান আরও বলেন, "এ বিষয়ে তখন একটি লিখিত প্রস্তাবও আমি দিয়েছিলাম। এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক। এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো কানেকটিভিটি তৈরি করছে না। তাই এই সড়ক নির্মাণের আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।"
গতবছর পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এমএ মান্নান হাওরের এসব সড়ক নির্মাণ ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, "হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।"
এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার এম এ মান্নান বলেন, "সিলেটে বন্যার জন্য এই সড়কই দায়ী- এমনটি বললে সরলীকরণ হয়ে যাবে। হাওরে এমন অসংখ্য স্থাপনা হয়েছে। তাছাড়া মিঠামইন সড়কের দূরত্ব সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে অনেক দূর।"
তিনি বলেন, "এখন থেকে হাওরে আর কোন সড়ক নির্মাণ করা হবে না, শুধু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে।"
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সিলেটের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, "কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের সড়ক দিয়ে পানি পারাপারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার। এই বন্যার মধ্যে আমার সেই রাস্তাকে পরিদর্শন করবো। সড়কটি পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।"