আগর-আতর ব্যবসার সৌরভ কেড়ে নিয়েছে মহামারি
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে বড় ধরণের ক্ষতিতে মৌলভীবাজারের বড়লেখার ঐতিহ্যবাহী আগর-আতরের ব্যবসা। বড়লেখার সুজানগরের আগর-আতর প্রায় শতভাগই বিদেশে রপ্তানি করা হয়, কিন্তু করোনায় ইন্টারন্যাশনাল বিমান ফ্লাইট বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০% শতাংশ বিক্রি কমে গেছে এবং ৪০০ কোটি টাকার আগর-আতর বিক্রয়ে লোকসান হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন আগর শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএমইএ) তথ্য অনুসারে, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় ৩৫০টি কারখানা থেকে প্রতি বছর আনুমানিক প্রায় ৮০০ কোটি টাকার আগর-আতর রপ্তানি করা হয়। এ শিল্পে প্রায় ৪ লাখ লোক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত, করোনায় ৫০-৬০% এরও অধিক শ্রমিক ইতোমধ্যে কাজ হারিয়েছে। করোনার প্রভাবে গত বছরে মাত্র আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকার আগর-আতর বিক্রি হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন তাসনিয়া ও তাবাসসুম আগর আতর ফ্যাক্টরির মালিক বকুল আহমেদ বলেন, "করোনায় মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় গত বছর আমার প্রায় ১ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে, প্রতি বছর আমি কম করে হলেও ২ কোটি টাকার আগর আতর বিদেশে রপ্তানি করতাম। এ বছরও যেভাবে লকডাউন যাচ্ছে, তাতে আমাদের ব্যবসায় ব্যাপক মন্দা চলছে"।
অপর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মা আগর আতর এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুল আজিজ টিবিএসকে বলেন, "এ বছর এখনো এক কেজি আগর-আতরও বিক্রি করতে পারি নাই, গত বছর আমার প্রায় ৬০ লাখ টাকার মাল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় অবিক্রিত রয়ে গেছে, এ অবস্থা চললে এবারও মনে হচ্ছে ৫০-৬০ লাখ টাকার মাল অবিক্রিত থেকে যাবে।
আমার কারখানায় করোনার আগে প্রায় ৩০ জন শ্রমিক কাজ করতো, করোনায় বেচাবিক্রি তেমন না থাকায় বর্তমানে ১০ জন শ্রমিক রয়েছে"।
এছাড়াও তিনি বলেন, "বর্তমানে আমার প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে, মাল বিক্রি না হওয়ায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধসহ কারখানার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, এই করোনায় এতো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে একটি টাকাও পাইনি"।
ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছরের শুরুতে করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় গত ৫-৬ মাস থেকে সীমিত হারে কিছু ব্যবসায়ী আগর-আতর রপ্তানি শুরু করেছিলেন। কিছুটা হলেও করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছিল কারখানা মালিকেরা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঘনঘন লকডাউন দেয়াতে আবারও রপ্তানিতে ব্যাপক মন্দা দেখা দিয়েছে।
এদিকে আগর-আতর রপ্তানির জন্য বন বিভাগ থেকে একটি বিশেষ সনদ (সাইতিস সার্টিফিকেট) নিতে হয় ব্যবসায়ীদের, যা অনেক সময় পেতে বিলম্ব হলে পণ্য রপ্তানিতে ভোগান্তি হয় তাদের। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই করোনাকালীন সময়ে এই সাইতিস সার্টিফিকেট তুলে নেয়া হোক বা দ্রুত সার্টিফিকেট দেয়া হোক।
এ ব্যাপারে সুজানগর পারফিউমের মালিক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, "করোনায় আমার প্রায় দুই কোটি টাকার পণ্য অবিক্রিত রয়েছে। করোনার ধকল কিছুটা কমায় এবার চেষ্টা করছি কিছু পণ্য রপ্তানি করবো। প্রায় ৬০ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করছি। করোনায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও কিছুটা কম, তারমধ্যে সাইতিস সার্টিফিকেটের জটিলতা আরো ভোগান্তি বাড়াচ্ছে"।
আগর কাঠের ব্যবসা ও সমাদর হাজার বছরের পুরনো। আগরের সুগন্ধ প্রশান্তিদায়ক, শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবেও কাজে লাগে। নানাবিধ ওষুধ, পারফিউম, পারফিউম জাতীয় দ্রব্যাদি-সাবান, শ্যাম্পু এসব প্রস্তুতে আগর তেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গৃহে, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সুগন্ধি ছড়ানোর জন্য আগর-আতর ব্যবহার করা হয়।
মৌলভীবাজার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা, রফিনগর, হাসিমপুর, চিন্তাপুর, বড়থল গ্রামসহ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে কম-বেশি এবং পাথারিয়ার পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগর চাষ হয়। চাষ শেষে কারখানায় উৎপাদিত আগর-আতর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে মৌলভীবাজারের বড়লেখার ব্যবসায়ীরা ভারতের আসাম ও মুম্বাইয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে আগর আতর উৎপাদন বা এর বিস্তার ঘটে ১৯৪০ সালের দিকে। বর্তমানে সিঙ্গাপুর ও দুবাইতে এই শিল্পের পাইকারি মার্কেট গড়ে উঠেছে, যা বড়লেখার বাসিন্দারাই পরিচালনা করছে। তবে ২০ বছর আগ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রপ্তানির ব্যাপক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘদিন আগর-আতর রপ্তানি বন্ধ রয়েছে ফলে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএমইএ) সেক্রেটারী কবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, "করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে আগর-আতরের দাম কিছু কমেও গেছে, এ বছর তেমন বিক্রি হয়নি বললেই চলে, প্রতি বছর আমি নিজেই ৬-৭ কেজি আতর রপ্তানি করতাম, গত বছর মাত্র ২ কেজি আতর রপ্তানি করতে পেরেছি"।
তিনি আরও বলেন, "বড়লেখার ৩৫০ জন কারখানার মালিকের মধ্যে মাত্র ১০-১৫ জন সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পেয়েছে, অথচ এখানকার ৯০% ব্যবসায়ীরই ব্যাংক লোন রয়েছে। এছাড়াও এখনো ৫০% কারখানাতে গ্যাস সংযোগ নেই, ব্যাংক জটিলতার কারণে কাচাঁমাল রপ্তানিতে সরকারের ২০% প্রণোদনা এখনো বেশিরভাগ ব্যবসায়ী নিতে পারছে না। সব মিলিয়ে এই শিল্পে অনেক মন্দা যাচ্ছে"।
বিএএমইএ'র প্রেসিডেন্ট আনসারুল হক টিবিএসকে বলেন, "বছরের অর্ধেক সময় চলে গেলেও এ বছর এখনো ১০-১৫% রপ্তানি হয়নি, লকডাউনের কারণে যেভাবে ঘনঘন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হচ্ছে আশঙ্কা করছি এ বছরও গত বছরের ন্যায় প্রায় ৪০০-৫০০ কোটি টাকার লোকসান হতে পারে"।
তিনি আরও বলেন, "বিশ্বে আগর-আতর পণ্যের প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি বাজার রয়েছে। সকল কারখানাতে গ্যাস সংযোগ, আতর-আগর রপ্তানিতে ২০% ভর্তুকিতে ব্যাংক জটিলতা সহজীকরণ ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে এসএমই প্রণোদনা দেয়া হলে আমাদের দেশে এ শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে এবং দেশীয় শ্রমের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থানের ফলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে"।