ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের মুখে বিশ্ব
ভ্যাকসিন আসার পর মহামারির দুর্বিষহ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে বিজ্ঞানীরা তড়িৎ গতিতে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করলেও, কোভিড ভাইরাসকে আয়ত্তে আনা এখনো বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের আগমন, চীনা ভ্যাকসিনের নিম্ন কার্যক্ষমতা সবকিছু মিলে পরিস্থিতিকে করে তুলেছে দুর্বোধ্য। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় উদ্ভূত ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট আরও ভয়াবহ হওয়ায় নতুন এক উদ্বেগের মধ্যে আছে পুরো বিশ্ব।
মডার্না গতকাল এক ঘোষণার মধ্যে দিয়ে জানায়, তাদের তৈরি ভ্যাকসিন ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধেও একইভাবে কার্যকর। তবে তাতে উদ্বেগ কমছে না। কেননা, ভ্যাকসিনের অন্যান্য প্রধান প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধের বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য আসেনি। এমনকি ফাইজারের বক্তব্য অনুসারে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তাদের ভ্যাকদিন কাজ করবে বলে তারা "আশাবাদী"।
ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা, তুরস্ক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর সংবাদ প্রতিবেদনে কেবল ভ্যাকসিন প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলোই উঠে আসছে। ভ্যাকসিনের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিতরণের বিভিন্ন বিষয় যেমন, কোন জনগোষ্ঠী সবার আগে ভ্যাকসিন পাবে, ভ্যাকসিনের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে ইত্যাদি প্রতিটি প্রশ্নের সাথেই টিকাদান প্রক্রিয়া পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাজারে চলে আসা ভ্যাকসিনগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন করে উদ্ভূত কোভিড-১৯ ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে কিনা সেটাই এখন সবথেকে বিতর্কিত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবে দ্রুততার সাথে ভ্যাকসিন এসেছিল, ঠিক সেভাবেই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনার উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন সবই প্রশ্নবিদ্ধ।
মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র উপায় এখন ভ্যাকসিনেশন। এই ভ্যাকসিনেশনের বাস্তবতা পরখ করতে এক এক করে সংবাদ প্রতিবেদনের দিকে নজর দিতে হবে।
কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চীনা ভ্যাকসিন সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা মূলত অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য এবং লুকোচুরির কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ।
ব্রাজিল, তুরস্ক এবং এশিয়ার বেশ কিছু দেশ থেকেই সিনোভ্যাকের জন্য নেতিবাচক বার্তা এসেছে।
ব্রাজিলের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভ্যাকসিনটি মাত্র ৫০.৪ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৩ জানুয়ারি গবেষকদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। পূর্বে যা বলা হয়েছিল তার তুলনায় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা অন্তত ৫০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। সিনোভ্যাক কোনোমতে সেই মানদণ্ডে পৌঁছাতে পেরেছে।
তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ব্রাজিলের গবেষকরা ট্রায়ালে ভ্যাকসিনটির কার্যক্ষমতা ৭৮ শতাংশ বলে ঘোষণা দিয়েছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বিভিন্ন দেশে সিনোভ্যাকের ট্রায়ালে বিভিন্ন ফলাফল উঠে এসেছে।
ডিসেম্বরে, তুর্কি গবেষকেরা অন্তর্বর্তী ট্রায়ালে সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা ৯১.২৫ শতাংশ পর্যন্ত পেয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ায় ১৪ জানুয়ারি থেকে গণ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। ডিসেম্বরে, প্রায় একই সময়ে দেশটি সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটি ৬৫.৩ শতাংশ কার্যকর বলে ঘোষণা দেয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে, আমেরিকান ভ্যাকসিন ফাইজার এবং মডার্নার তুলনায় চীনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কম বলে উঠে এসেছে।
ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের বিষয়ে সিনোভ্যাকের সাথে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর চুক্তি করেছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘোষণার পর উভয় দেশই জনগণকে নিশ্চিত করেছে যে, তারা একমাত্র নিরাপদ এবং কার্যকর ভ্যাকসিনেরই অনুমোদন দিবে।
সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী এক সাবেক কর্মকর্তা বিলাহারি কাউসিকান জানান, "আমি এখন কোনো চীনা ভ্যাকসিন নিব না। কারণ এখানে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।" তিনি আরও জানান, একমাত্র "যথাযথ প্রতিবেদন" পেলে, তবে তিনি ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
ফিলিপাইন সরকারও সিনোভ্যাকের সাথে চুক্তি করে আইনপ্রণেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের নিম্ন মূল্য এবং সহজ সংরক্ষণের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পট-পরিবর্তনে এই ভ্যাকসিন ভূমিকা রাখবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ৬৫ বছরের বেশী বয়সী মানুষদের জন্য ভ্যাকসিনটি কার্যকর হবে কিনা, তা এখন এক বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জার্মান দৈনিক হ্যান্ডেলসব্ল্যাট এবং বিল্ড বলছে, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের উপর ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা যথাক্রমে ৮ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের কম।
বিল্ডের অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের জন্য এই টিকার অনুমোদন দিবে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জার্মানির কর্মকর্তারা।
ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা বিষয়টি অস্বীকার করলেও বিতর্কটি ভিত্তিহীন নয়।
যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রধান ট্রায়ালটি ৫৫ বছরের কম বয়সীদের নিয়ে শুরু হয়েছিল। কেননা, প্রথম দিকে ট্রায়ালটি স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রথম সারির কর্মরত কর্মীদের উপর করা হয়েছিল।
ট্রায়ালে বয়স্কদের পরে যুক্ত করা হয়েছিল। ফলে, তাদের উপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ফলাফলও দেরীতে আসে।
৮ ডিসেম্বর মেডিক্যাল সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা নথির তথ্যানুযায়ী, বয়স্কদের সংক্রমণ অনুযায়ী ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতার নথি অসম্পূর্ণ ছিল।
"সংক্রমণের কেস সংখ্যা যথেষ্ট না থাকায় বয়স্কদের উপর কার্যকারিতার তথ্য এখন পর্যন্ত সীমিত। তবে ভবিষ্যতে পর্যালোচনার পর নতুন তথ্য সহজলভ্য হবে," প্রতিবেদনটিতে বলেন গবেষকেরা।
এদিকে, ভ্যাকসিন সরবরাহ হতে দেরী হওয়ায় টিকাদান কর্মসূচীও আটকে আছে।
ব্রাজিল এবং তুরস্কের কর্মকর্তাদের অভিযোগ চীনা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পাঠাতে দেরি করছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
অন্তত ২৪ টি দেশ চীনের সাথে ভ্যাকসিন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এদের অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ। ধনী রাষ্ট্রগুলো যখন ফাইজার এবং মডার্নার অধিকাংশ ভ্যাকসিনের বরাদ্দ নিয়ে নিয়েছে, তখন চীন তাদের ভ্যাকসিন উন্মুক্ত করেছিল দেশগুলোর সামনে।
"তবে চীনা ভ্যাকসিনের সরবরাহে দেরি হওয়ায় এবং ভ্যাকসিনগুলোর অপেক্ষাকৃত কম কার্যকারিতার জন্য দেশগুলো থেকে কোভিড বিদায় নিতে সময় লাগবে," বলছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন।
ইউরোপ থেকে আসা সংবাদগুলোও আশাব্যঞ্জক নয়।
বছরের প্রথম সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের চেয়ে দ্রুত টিকাদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভ্যাকসিন সংগ্রহ পদ্ধতি এখন তদন্তের মুখে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যানুযায়ী, প্রতি একশ জনের জন্য যুক্তরাজ্য ১০টির বেশি ভ্যাকসিন বরাদ্দ করেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতি একশ জনে ভ্যাকসিন বরাদ্দের হার যথাক্রমে ছয় ডোজের বেশী এবং দুই ডোজের কম।
"বাড়তে থাকা এই বৈষম্য ইউরোপের রাজধানীগুলোতে উদ্বেগের সঞ্চার ঘটিয়েছে, বিশেষ করে ভ্যাকসিন সরবরাহের টানাপোড়েনে অবস্থার অবনতি হয়েছে।"
এদিকে শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা জানান, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের এক-চতুর্থাংশ সরবরাহের অর্ধেকের বেশি ভ্যাকসিনই আসবে না। প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপীয় সরবরাহ চেইনের সক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিল।
দেশগুলো যখন ভ্যাকসিনের চাহিদা মেতাতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা এক নতুন উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।
মডার্না এবং ফাইজারের ভ্যাকসিন যথাযথভাবে সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হল, ভ্যাকসিনগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার কোভিড ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে তেমন কার্যকর নয়। যুক্তরাজ্যের নতুন ভ্যারিয়েন্টের থেকেও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট অধিক প্রাণঘাতী।
ভ্যাকসিনের আশায় বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে যে হাওয়া লেগেছিল, নতুন এসব প্রতিবন্ধকতায় তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ২৪ জানুয়ারি ব্লুমবার্গের একতি প্রতিবেদনে বলা হয়, "২০২১ সালে যেমনটা আশা করা হয়েছিল, অর্থনীতির শুরুটা সেভাবে হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ ঢেউ এবং টিকাদানের বিলম্বতা নতুন বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির সূচনাকে কঠিনতর করে তুলেছে।"
দ্য ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক একটি আর্টিকেল ভ্যাকসিনের ঐতিহাসিক রেকর্ডকে মনে করিয়ে দেয়। প্রতিবেদনটি বলছে, "তাত্ত্বিকভাবে ক্লিনিক্ল্যাল ট্রায়ালে ভ্যাকসিনের যে উচ্চ কার্যক্ষমতা দেখানো হয়, তাতে ভাইরাসকে পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। অথচ, আজ অবধি গুটিকয়েক ভ্যাকসিনই মহামারি থামাতে সক্ষম হয়েছে।"
- মূল লেখা: World faces new concern over vaccines
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা