উৎপাদন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের অনুমতি
১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া আগামী অর্থবছরে উৎপাদন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিচ্ছে সরকার। সেক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে আয়কর অধ্যাদেশে '১৯এএএএএএ' নামে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করা হবে। ধারাটি ৩০ জুন ২০২২ থেকে কার্যকর হবে বলে জানা যায় অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে।
এছাড়াও পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট, জমি, ব্যাংক ডিপোজিট ও সঞ্চয়পত্রেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখবে সরকার। সেক্ষেত্রে প্রদেয় করের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ কর দিতে হবে জরিমানা হিসেবে।
কর্মকর্তারা জানান, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য অংশীদারদের দাবির প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত বৃহস্পতিবার অর্থবিল সংশোধনীতে কালো টাকার উৎস সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলা থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে বিরত রাখতে একটি আইনি দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব পাঠায় সংসদে।
২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে সরকার হাই-টেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে মাত্র ১০ শতাংশ করে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ একপ্রকার বন্ধই হয়ে গেছে। ফলে এই খাতে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে না। মহামারির কারণে অনেক কারখানা তাদের কার্যক্রম সঙ্কুচিত হয়ে গেছে অথবা টিকে থাকার জন্য শ্রমিকদের ছাঁটাই করে ফেলেছে।
এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় শিল্পখাতকে সচল রাখতে ও কর্মসংস্থান বাড়াতে উৎপাদন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের বিশেষ সুযোগ দিতে চায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অর্থমন্ত্রী যে পরিমাণ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছেন, প্রায় প্রতারণার শামিল।
তিনি আরও বলেন, 'বাজেট বক্তৃতার সময় মন্ত্রী এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, যেন তিনি আর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাড়াবেন না। কিন্তু, বাজেট বক্তৃতার পর আবার কালো টাকা সাদা করার এই বিধান ফিরিয়ে আনাটা একটা ষড়যন্ত্র।'
কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয় বলে মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'অর্থমন্ত্রী যদি কালো টাকা সাদা করার জন্য কোনো জরিমানাও চাপিয়ে দেন, তবু তা ন্যায়সঙ্গত নয়। এটি বৈষম্যমূলক এবং অনৈতিক সিদ্ধান্ত।'
তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক চেতনা ও দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
তবে ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, কালো টাকা বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে প্রদেয় করের অন্তত ১৫ শতাংশ জরিমানা হওয়া উচিত।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রহমান বলেন, 'জরিমানা আরোপ করে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া একটি ভালো উদ্যোগ। তবে জরিমানার পরিমাণ একেবারেই কম, যা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের উচিত নিয়মিত করহার এবং করফাঁকি দেওয়া অর্থ বৈধকরণের জরিমানার মধ্যে যৌক্তিক পার্থক্য সৃষ্টি করা।'
বিল্ড বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান বলেছেন, 'কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে অন্তত ৩৫ শতাংশ জরিমানা নির্ধারণ করা উচিত। কেননা, সম্পদের ওপর কর দেওয়ায় উচ্চ-আয়ের করদাতাদের করের বোঝা ৩৫ শতাংশের বেশি হয়।'
আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএএ ধারা অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করতে একজন বিনিয়োগকারীকে ২৫ শতাংশ করের সাথে প্রদেয় করের উপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনবিআরের প্রস্তাব অনুসারে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের এক বছরের মধ্যে কেউ অর্থ উত্তোলন করলে তাকে অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হবে।
তারা আরও জানান, আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএ ধারার আওতায় সরকার ফ্ল্যাট ও জমির মতো অপ্রদর্শিত সম্পদও বৈধ করার সুযোগ দেবে। এ ধরনের সম্পদের মালিকদের প্রদেয় করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দেয়ার পাশাপাশি ফ্ল্যাট ও জমির আকার এবং অবস্থান অনুযায়ী প্রতি বর্গমিটারের জন্য ২০০ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে। অপ্রদর্শিত ব্যাংক ডিপোজিট ও সঞ্চয়পত্রগুলোকেও অনুরূপ জরিমানা ও ২৫ শতাংশ করের মাধ্যমে বৈধ করার অনুমতি দেওয়া হবে।
বিদায়ী অর্থবছরে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল।
নতুন প্রস্তাব গৃহীত হলে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪'র আওতায় সিকিউরিটি বিনিয়োগ এবং অপ্রদর্শিত সম্পদ ও নগদ অর্থের জন্য বিশেষ কর ব্যবস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার বর্তমান বিধানগুলো বাদ পড়বে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১০ হাজার ৩৪ জন ব্যক্তি ১৪২.৯৫ বিলিয়ন টাকা সমমূল্যের নগদ অর্থ ও সম্পদ বৈধ করেন। এর বিপরীতে রাজস্ব বোর্ড ১৪.৩৯ কোটি টাকা কর পেয়েছে।
এদের মধ্যে মোট ৯ হাজার ৬৯৩ জন ব্যক্তি নগদ, ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট, সঞ্চয়পত্র সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য সম্পদ মিলিয়ে ১৩৮.৬০ বিলিয়ন টাকা সাদা করেন। বিপরীতে ১৩.৯০ বিলিয়ন টাকা কর প্রদান করেন।
অন্যদিকে, ৩৪১ জন ব্যক্তি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৪.৩৫ বিলিয়ন টাকা বৈধ করেন এবং কর হিসেবে ৪৯০ মিলিয়ন টাকা প্রদান করেন।
দেশে বর্তমানে কালো টাকার পরিমাণ সম্পর্কে জানার মতো কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনে কালো টাকার পরিমাণ বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৩৭ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করা হয় বলে সংস্থাটির অনুমান।
২০১৮ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতি কর্তৃক পরিচালিত জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থের বার্ষিক সঞ্চালনের পরিমাণ ৫ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা।