করদাতাদের হয়রানি কমাতে কর ন্যায়পাল গঠনের প্রস্তাব
করদাতাদের হয়রানি কমানো, রাজস্ব দপ্তরের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তার জন্য কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রতি বছর রাজস্ব আইনে পরিবর্তন উদ্যোক্তাদের স্থায়ী পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে বাজেটে কর আইনে কয়েক বছরের স্থায়ী নীতি তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে কর নেট বাড়িয়ে নিয়মিত করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমানোর প্রস্তাব করেছেন তারা।
শবিবার 'ন্যাশনাল বাজেট ২০২১-২২: পলিসি রিকমান্ডেশন' শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা এ আহ্বান জানান। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত আগামী বাজেট ঘিরে এ সভার আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি)।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইএফবিআইবির ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, 'কর ন্যায়পালের ধারণাটি কয়েক শতাব্দী পুরনো। সুইডেনে এর প্রথম প্রয়োগ। সুইডেনের পর নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে ন্যায়পালের ধারণা বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই সরকারের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য কর ন্যায়পাল পদ্ধতি একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষভাবে স্বীকৃত।'
করোনার এ সময়ে রাজস্ব আহরণের অতিরিক্ত চাপের কারণে কর কর্মকর্তারা যেন ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে পারেন, সেজন্য এখন কর ন্যায়পাল অতি জরুরি বলে উল্লেখ করেন আব্দুল মজিদ।
এর আগে বাংলাদেশে ২০০৫ সালে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০১১ সালে তা বাতিল করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবে তা কার্যকর না হওয়া এবং সরকারের ব্যয় সংকোচনের কথা বলে নেওয়া হয় সেই সিদ্ধান্ত।
রাজস্ব আইন প্রয়োগকালে কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, তথা স্বেচ্ছাচার ও হয়রানিমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর ন্যায়পালের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। কর ন্যায়পাল সেই আভিযোগ অনুসন্ধান করে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করতে পারেন। এছাড়া কর ন্যায়পাল কর প্রশাসন কর্তৃক অনিয়ম, আইনকানুন বিধিবিধানবহিভূত প্রয়োগ ও দুর্নীতি করলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
বিশ্বের ১১৪টি দেশে বর্তমানে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসাবে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিকুর রহমান বলেন, 'বাজেট সংস্কার নিয়ে প্রতি বছরই কিছু আলোচনা হয়। তবে এবার করোনার কারণে বেশি সংস্কার করতে হবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।'
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সুষমবন্টন জরুরি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল দিক রাজস্ব আহরণ- উল্লেখ করে আগামী বাজেটে এ খাতে বড় সংস্কারের প্রস্তাব করেন সিপিডির ডিস্টিঙ্গুইসড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, 'করোনার এ সময়ে অর্থনৈতি পুনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে সরকারি ব্যয় বাড়ানো। সরকারি ব্যয় বাড়াতে হলে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। গত এক দশক ধরে সরকারের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান এনবিআর। জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আহরণ ১৫-১৬ শতাংশ লক্ষ্য ধরা হলেও এটি সব সময় ১০ শতাংশের নিচে ছিল।'
করোনা পরবর্তী সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগ যেন বৃদ্ধি পায়, এমন বাজেট পলিসি নির্ধারণ করতে হবে বলে জানান ড. দেবপ্রিয়।
এদিকে, আগাম বাজেট অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাসচিব খান আহমেদ সাঈদ মুরশিদ।
তিনি বলেন, 'আগামী বাজেটে একদিকে সরকারকে রাষ্ট্রের আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে করের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে।'
ছাড়ের ক্ষেত্রে আরএমজির পাশাপাশি ওষুধ, চামড়া, এসএমইসহ ইমাজিং খাতগুলোকেও বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেন কেএস মুরশিদ।
ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাঁচামাল আমদানিতে সরকারের শুল্ক নীতির প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন বিএসআরএম গ্রুপ অব কোম্পানির চেয়ারম্যান আলী হুসাইন আকবর আলী।
কাঁচামাল আমদানির পর বন্দরে সময়ক্ষেপন ও রড-সিমেন্টের কাঁচামালে অতিরিক্ত কমানোর প্রস্তাব করেন তিনি। পাশাপাশি সাব কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আইবিএফবির প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ।