এমএনসিগুলোর কর ফাঁকি শনাক্তে প্রথম ট্রান্সফার প্রাইসিং অডিট শুরু করেছে এনবিআর
ট্রান্সফার প্রাইসিং বিধিমালা করার এক দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে— এর প্রতিপালন নিশ্চিত করতে, প্রথমবারের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএনসি) নিরীক্ষা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে করফাঁকি দেওয়ার কোনো কৌশল অবলম্বন করেছে কিনা– তা শনাক্ত করতেই করা হবে এ অডিট।
রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এটি একটি বড় পদক্ষেপ। যেসব দেশে মুনাফা স্থানান্তর করলে কম কর দিতে হয়, অনেক সময় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সেখানে তা স্থানান্তর করে। এতে সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। আর এ ধরনের মুনাফা স্থানান্তর রোধ করাই অডিটের লক্ষ্য।
ট্রান্সফার প্রাইসিং হচ্ছে হিসাবরক্ষণের একটি পদ্ধতি, যেখানে কোম্পানির একটি বিভাগ অন্য বিভাগকে তাদের সরবরাহ করা পণ্য বা সেবার জন্য চার্জ করে বা সেগুলোর মুল্য পরিশোধ করতে বলে। আইনগতভাবে স্টান্সফার প্রাইসিং এর মাধ্যমে সহযোগী ও অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদের অর্জিত আয় বরাদ্দ করতে পারে এমএনসিগুলো।
গত মাসে শুরু হয়ে এই অডিট, যেখানে দারাজ ডটকম, হাইডেলবার্গ ম্যাটেরিয়েলস বাংলাদেশ পিএলসি এবং প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড – এই তিন কোম্পানির আন্তর্জাতিক লেনদেন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, বহুজাতিক আরও কোম্পানিগুলোকে এ নিরীক্ষার আওতায় আনা হবে।
এই তিন এমএনসির আন্তর্জাতিক লেনদেন বর্তমানে অডিটের আওতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের আন্তর্জাতিক কর- এর সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম।
রাজস্ব বোর্ডের আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ব্যাখ্যা করে বলেন, কোম্পানিগুলোর লেনদেনে তাদের পণ্য, সেবার মূল্য এবং অন্যান্য পেমেন্টের সাথে অন্যান্য দেশে তাদের অঙ্গ বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব মূল্যের তুলনা করবে এই অডিট। ট্রান্সফার প্রাইসিং এর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যবহার করে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ কর্তৃপক্ষ কর ফাঁকি বা এড়ানোর উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ভুল ঘোষণা যাচাই করবে, প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কর ফাঁকি রোধে বাংলাদেশ অর্থ আইন ২০১২ - এ ট্রান্সফার প্রাইসিং বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এনিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও – আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্যভাণ্ডার বা ডেটাবেজের অভাবে এর কার্যকর বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা করা ৯০০টির বেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বা এমএনসিকে তাদের লেনদেনের তথ্য জমাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এসব কোম্পানির আন্তর্জাতিক ডেটাবেজে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার না থাকায় তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ফের নিরাশ হতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এবং যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটি সংস্থার সহায়তায় সম্প্রতি বৈশ্বিক একটি লেনদেনের ডেটাবেজের অ্যাক্সেস পেয়েছে বাংলাদেশ। যার সুবাদে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গত মাসে নিরীক্ষাটি শুরু করতে সক্ষম হয়।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, তবে একইসঙ্গে সতর্ক করে বলেছেন, এটি যথাযথভাবে না করা গেলে– বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে। এ ধরনের জটিল অডিট পরিচালনার জন্য এনবিআরের সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করার ওপরও গুরুত্ব দেন তাঁরা।
ট্রান্সফার প্রাইসিং কী?
একই মালিকানা বা নিয়ন্ত্রকের অধীনে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে লেনদেনের জন্য মূল্য নির্ধারণের একটি পদ্ধতি হচ্ছে ট্রান্সফার প্রাইসিং। সাধারণত এর মাধ্যমে সুদ, মুনাফা, সম্পদ বা পণ্যের মূল্য প্যারেন্ট কোম্পানিকে দেওয়া হয়, বা আমদানিকৃত সেবার মূল্য পরিশোধ করা হয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় (এমএনসি) যা একটি সাধারণ বিষয়।
অনেক সময় কোম্পানিগুলো তাদের তহবিল উচ্চ কর আছে এমন দেশ বা অঞ্চল থেকে - যেসব দেশ বা অঞ্চলে কম কর সেখানে স্থানান্তর করে, তাদের করভার কমিয়ে মুনাফাকে সর্বোচ্চ করতে। এতে উচ্চ কর থাকা দেশের কর্তৃপক্ষ প্রায়ই প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশে কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক করে হার সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত, তাই নিম্ন করের দেশগুলোর সাথে লেনদেনে এদেশে ব্যবসারত এমএনসিগুলো পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়িয়ে দেখাতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে বিদেশে তহবিল স্থানান্তর করে তারা সেখানে উচ্চ মুনাফা দেখাতে পারে। ফলে বাংলাদেশের করযোগ্য রাজস্ব হ্রাস পায়।
রাজস্ব বোর্ডের সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে এক হাজারের বেশি এমএনসি বা বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, এরমধ্যে উচ্চ-লেনদেন থাকা কোম্পানিগুলোকে অডিটের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ট্রান্সফার মিসপ্রাইসিং যেভাবে হয়
সার্বিক কর দায় কমাতে কোনো এমএনসি যখন বিভিন্ন দেশে থাকা তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লেনদেনের মূল্যে কারসাজি করে তখন ট্রান্সফার মিসপ্রাইসিং হয়।
যেমন নিম্ন করের দেশ থেকে উচ্চ করের দেশে কেনা কোনো পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেখাতে পারে কোনো এমএনসি। এতে উচ্চ করের দেশে তাদের ঘোষিত মুনাফা কমে যায়, ফলে করও সেখানে কম দিতে হয়। অন্যদিকে এর ফলে নিম্ন করের ওই দেশে তাদের মুনাফা বেড়ে যায়। মুনাফার এ ধরনের স্থানান্তর কোম্পানির মোট কর পরিশোধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মূল্য নির্ধারণের এমন কৌশল ছাড়াও – ব্যবস্থাপনা ব্যয় (সদর দপ্তর ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান) বাবদও কর এড়ানোর সুযোগ পায় এমএনসি। এছাড়া অপরিমাপ্য সম্পদ বা মেধাসত্ত্ব (যেমন রয়্যালটি, ফি, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, ব্র্যান্ড নেম, ফ্যাঞ্চাইজি ইত্যাদি) এবং সাধারণ ব্যয়ের বন্টন ও সুদ বাবদ ব্যয়ের ভুল তথ্য দিয়েও এমনটা করা যায়।
রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল এর সাবেক যুগ্ম পরিচালক ও বর্তমানে কর অঞ্চল ১৫ এর কমিশনার মো. শাব্বির আহমেদ এর "ট্রান্সফার প্রাইসিং কনসেপ্ট: বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ" শীর্ষক এক গবেষণায় অনুযায়ী, বৈশ্বিক লেনদেনের প্রায় ৬০ শতাংশ গ্রুপভিত্তিক কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট সত্ত্বাগুলোর মধ্যে হয় (যাদেরকে সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান বলা হয়)।
অডিটের উদ্যোগকে বিশেষজ্ঞদের সাধুবাদ
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স (এফআইসিসিআই) রাজস্ব বোর্ডের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে, বিশেষজ্ঞরাও এটিকে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।
কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিং অডিটের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর এড়ানো কমাতে পেরেছে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র তথ্যমতে, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৭৯টি দেশ মূল ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে আছে আর্মস লেংথ প্রিন্সিপাল বা বিধিমালা।
এই আর্মস লেংথ বিধি অনুসরণ করেই অডিট করছে এনবিআর। এনবিআরের সূত্রগুলোর মতে আর্মস লেংথ বলতে, এমন একটি ব্যবসায়িক চুক্তিকে বোঝায়– যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে প্রভাবিত না করে স্বাধীনভাবে কাজ করে।
@এই অডিটের সক্ষমতা আছে এনবিআরের?
এনবিআরের বর্তমান সক্ষমতার মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, ট্রান্সফার প্রাইসিং অডিটের জটিলতা নিয়ে তাদের উদ্বেগ-ও তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এফআইসিসিআই বা ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, "এটা খুবই জটিল একটা মেথড। এনবিআরের সেই ক্যাপাবিলিটি কি আছে? কারণ সঠিক মেথডে না করলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কিন্তু ভুল বার্তা দেওয়া হবে।"
এটি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের করা প্রথম ট্রান্সফার প্রাইসিং অডিট হওয়ায় – বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য এটি সংশোধনের সুযোগ রাখার পরামর্শ দেন স্নেহাশীষ বড়ুয়া।
তিনি উল্লেখ করেন যে, কর নির্ধারণের সময় প্রায়ই ভিন্ন মত দেখা দেয়, তাই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেন অন্যায্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। কারণ তাহলে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। তবে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই অডিটের প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
বর্তমানে রাজস্ব বোর্ডের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল এর কর্মকর্তা ৮ জন, এদের মধ্যে দুজন দেশের বাইরে থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই অডিটের কাজ করছেন।
এনবিআরের ইনকাম ট্যাক্স পলিসির সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল আরও সক্রিয় হলে তা কর্পোরেট কমপ্ল্যায়েন্স বাড়াতে পারবে, তবে এই কাজটি যেন সঠিকভাবে করা যায়– সেজন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
১২ বছর অপেক্ষা করতে হলো কেন?
এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এবিষয়ে গুরুত্ব না থাকা এই বিলম্বের অন্যতম একটি কারণ।
এনবিআরের এক কর্মকর্তার মতে, ওই সময়ে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড পূরণ করবার মতো অডিটের জন্য প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত জনবল, বাজেট ও একটি শক্তিশালী ট্রান্সফার প্রাইসিং কাঠামোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল।
কর্মকর্তারা বলেছেন, এক দশক আগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠিত হলেও, কখনোই এটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়নি– জনবলের ঘাটতি তো ছিলই, এমনকী আন্তর্জাতিক ডেটাবেজে অ্যাক্সেসের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দও দেওয়া হতো না।