করোনাকাল: ২০০ কোটি টাকার আগর আতর অবিক্রিত
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন। আগর আতর উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এই এলাকায় রয়েছে অনেকগুলো কারখানা।
এখান থেকে উৎপাদিত শত কোটি টাকার আতর প্রতিবছর পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর কী পরিমাণ আতর বিদেশে রপ্তানি হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। মূলত বিদেশগামী ব্যক্তিদের মাধ্যমে লাগেজ পদ্ধতিতে আতরটি বেশি পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, করোনাকালে এই খাতে জড়িতদের অন্তত ২০০ কোটি টাকার আতর অবিক্রিত রয়েছে। করোনার কারণে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় প্রবাসীদের মাধ্যমে এই আতর পাঠানো যায়নি।
আগর আতরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন মৌলভীবাজারের অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। বন বিভাগের তথ্যমতে, নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ১৭৬টি হলেও এর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বৈধ ও লাগেজ পথে জেলা থেকে সাত হাজার লিটার আতর বিদেশে পাঠানো হয়েছে। প্রতি লিটারের গড় দাম ছয় লাখ টাকা হিসেবে যার বাজার মূল্য প্রায় ৪২০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, আগর কাঠ রপ্তানি হয় প্রায় ১০ হাজার কেজি। যার বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
সংগঠনটি আরও জানায়, সারা বছর আগর আতর তৈরির কাজ চললেও জানুয়ারি থেকে শুরু হয় এর রপ্তানির মৌসুম। কিন্তু চলতি বছর করোনার কারণে মার্চের পর থেকে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আটকে যায় আগর আতর রপ্তানি। ফলে গত পাঁচ মাসে ২০০ কোটি টাকার আতর অবিক্রিত রয়ে গেছে। তবে সংরক্ষণের সহজ পদ্ধতি থাকায় তা নষ্ট হয়নি।
সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আনসারুল হক জানান, বৈধ পথে যে পরিমাণ আতর রপ্তানি হয়, তারচেয়ে বড় অংশ চলে যায় বিভিন্ন যাত্রীদের লাগেজে করে। বছরে আনুমানিক সাত হাজার লিটার আতর এবং ১০ হাজার কেজি কাঠ রপ্তানি হয়। তবে এর সরকারি কোনো হিসেব নেই। এমনকি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কাছেও এ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
তিনি বলেন, 'চলতি বছর করোনার কারণে আগর তেমন রপ্তানি করা যায়নি। সব দেশের সঙ্গে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচের সঙ্গে ফ্লাইট সুবিধা স্বাভাবিক হলে আগরের বিক্রি বাড়বে।' তবে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়েছে, তাতে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলেও বিলাসবহুল এই পণ্য বিক্রিতে মানুষের আগ্রহ কতটা থাকবে, সে ব্যাপারে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
গত বছর তিনি নিজেই বিদেশে আগর আতর পাঠিয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার লিটার। কিন্তু এই বছর বিভিন্নভাবে সামান্য পাঠাতে পারলেও তা গত বছরের তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ।
আগর আতর ব্যবসায়ী কবির আহমদ চৌধুরী বলেন, 'রপ্তানি বন্ধ আছে, কারণ চাহিদা নেই। পূর্বের সব অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। যেহেতু পুরাতন পণ্য জমে আছে, তাই নতুন করে উৎপাদনের কাজ করতে পারছি না।'
এদিকে, বিপাকে পড়েছেন ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা। আগর বিদেশে পাঠাতে না পাড়ায় তারা নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তারা চাইছেন, সরকারের সহযোগিতা এবং সহজ শর্তে ঋণ।
আবার ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা রপ্তানি করতে না পেরে আর্থিক সংকটের কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সুজানগরের এম এম আগর আতর ট্রেডিং এর পরিচালক বাবুল আহমেদ বলেন, 'গত বছর আমি ৭০০ তোলা (এক তোলা=১১.৬৬ গ্রাম) আতর বিদেশে পাঠালেও এ বছর কিছুই পাঠাতে পারিনি। ঘরে এখনো ৪০০ তোলা পড়ে রয়েছে। এ অবস্থায় চরম আর্থিক সমস্যায় পড়েছি।'
আমেনা অ্যান্ড ফাতেমা আগর উড অ্যান্ড পারফিউমের পরিচালক আদিব মজিদ বলেন, 'গত বছর ৬০০ তোলা আতর ও ৪০ কেজি কাঠ বিদেশে পাঠাই। এ বছর একেবারে শূন্য। গত পাঁচ মাস বিক্রি একেবারে বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি কিছু আতর বিক্রি হচ্ছে।'
'স্থানীয় মহাজনরা করোনার সংকটকে কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম দামে আতর কিনে রাখছেন। বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে তা তারা লাগেজ পদ্ধতিতে বিদেশে পাঠাবেন,' বলেন তিনি।
আগর-আতরের ব্যবহার
কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, আগর কাঠকে ঈশ্বরের কাঠ বলা হয়। পূর্ব এশিয়া ও জাপানে আগর কাঠ পূজার অর্ঘ্য উপকরণ। মধ্যপ্রাচ্যে আগর কাঠের ব্যবসা ও সমাদর হাজার বছরের পুরনো। আগরের সুগন্ধ প্রশান্তিদায়ক, অনেকেই শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগে।
এ ছাড়া নানাবিধ ওষুধ, পারফিউম, পারফিউম জাতীয় দ্রব্যাদি-সাবান, শ্যাম্পু- এসব প্রস্তুতে আগর তেল ব্যবহার করা হয়। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আগর আতর ও আগর কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করে।
আতর বাংলাদেশে তরল সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আগর গাছের উৎপাদন কৌশল
বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, পতিত জমি, টিলার ঢালে, টিলা বা পাহাড়ে এমনকি পরিত্যক্ত জায়গায় আগর গাছ লাগানো যায়। পাহাড় বা টিলা জমিতে আগর গাছ ভালো জন্মে। তবে সব জমিতেই কমবেশি জন্মে।
বৈধ পদ্ধতিতে রপ্তানিতে অনিহা যে কারণে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ১০ লিটার আতরের নির্যাসের জন্য ঋণপত্র খুলতে যে খরচ হয়, মাত্র এক লিটার পাঠাতে খরচ একই। ছোট ব্যবসায়ীরা এই খরচ দিতে না পারায় লাগেজ পদ্ধতিতে সৌদি আরব, কুয়েত, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে থাকেন। সরকার যদি রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি ঋণপত্রের বিষয়টি নজরে আনে, তাহলে বৈধ পদ্ধতিতে আগর আতর বিদেশে রপ্তানি বাড়বে; বাড়বে রাজস্ব আদায়ও।
ব্যবসায়ীরা চাইছেন সহজ শর্তে ঋণ এবং সরকারি সহযোগিতা। এরইমধ্যে সরকার থেকে তাদের তালিকা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, 'আগর আতরের নতুন নতুন বাজার তৈরি করার জন্য, বিশেষ করে ইউরোপের বাজার ধরার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের যে সকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের বিষয়েও আমরা কাজ করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'করোনাকালে তারা যে সমস্যায় পড়েছেন, তা নিয়ে আমরা গুরুত্ব সহকারে শিল্প মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে টিম এসে সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছেন।'
'ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের যে দাবি রয়েছে তা পূরণে আমরা এনেকখানি এগিয়ে গিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই সকল সমস্যার সমাধান হবে,' বলেন জেলা প্রশাসক।