কর ছাড় ও ব্যবসা মন্দায় বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি
ঢালাওভাবে করছাড় ও ব্যবসা মন্দার কারণে বাড়ছে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩.০৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ কম পেয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
ফলে পরিচালন ব্যয় মেটাতে ব্যাংক নির্ভর হচ্ছে সরকার। অন্যদিকে প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে এনবিআরের জন্য।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এলএনজি আমদানি-সরবরাহ, তৈরি পোশাক ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কর-ভ্যাটসহ বিভিন্ন করে চলতি অর্থবছরেই ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি দেশে ব্যবসা মন্দার কারণে গাড়ি, সিমেন্টের ক্লিংকার, ক্যাপিটাল মেশিনাররিসহ বৃহৎ শুল্কের পণ্য আমদানি কমে গেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা বাড়লেও রাজস্ব আহরণ কাঙ্খিত হারে বাড়ছে না।
সংস্থাটির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, ব্যবসা সহজকরণ ও সরকারের অনুরোধের কারণে চলতি অর্থবছরে এলএনজিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা, তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসে করে ২ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকের করপোরেট করে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে কয়েক হাজার কোটি টাকার কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থ বছরের শুরুর দিকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়ন ও ব্যবসায় মন্দার কথা জানিয়ে সিগারেটসহ বেশ কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ীরা ভ্যাট কম দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এনবিআরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। যার বিপরীতে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা কম।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় প্রথমার্ধে রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে পিছিয়ে কাস্টমস খাত। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৪ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে এ খাতটি। রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.৯৬ শতাংশ।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়ি, সিমেন্টের ক্লিংকার, ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ বৃহৎ শুল্কের পণ্য আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি সিগারেট, ব্যাংক ও ইস্পাতসহ নির্মাণ খাতের প্রায় সব উৎস থেকেই রাজস্ব আহরণে কমেছে। ফলে প্রথমার্ধে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়নি রাজস্ব বোর্ড।
এনবিআরের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে। সর্বশেষ হালনাগাদ হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে চলতি পেট্রোলিয়াম ছাড়া সব প্রায় সব পণে্যর আমদানি কমেছে। কর অব্যাহতি প্রাপ্ত পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ১৭ শতাংশ বেড়েছে আর সামগ্রীক আমদানি কমেছে ৪.৩৫ শতাংশ।
অর্থনীতির জন্য এ বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আমদানি কম হওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো হলেও এখানে চিত্র ভিন্ন। আমদানির সঙ্গে রফতানিও কমেছে। মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে। মূলত অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে সরকারের জন্য।
আমদানির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার অনেক পিছিয়ে ভ্যাট আহরণও। দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি ঘাটতি স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট খাতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১.০৩ শতাংশ ঘাটতিতে রয়েছে এনবিআর। প্রথম ছয় মাসে ৫১ হাজার ৯৯৬ কোটির স্থলে আদায় হয়েছে ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পরে এলএনজিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে কর অব্যাহতি ও ব্যবসায়ীক মন্দার কারণে কাঙ্গিত রাজস্ব পায়নি তারা ।
সংস্থাটির ভ্যাট বিভাগের সদস্য আব্দুল মান্নান শিকদার বলেন, বছরের শুরুর দিকে সাধরণত ভ্যাট আহরণ কম হয়। তবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানি ইএফডি মেশিন বসানো সম্পন্ন হলে ভ্যাট আহরণ বাড়বে। বছর শেষে এ খাতে ঘাটতি কমে আসবে।
শুল্ক ও ভ্যাট খাত অনেক পিছিয়ে থাকলেও তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে আয়কর খাত।
এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার ৮১.৪৬ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এনবিআর। ৪০ হাজার ৭৫ কোটি টাকার স্থলে এ খাতে আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবু হেনা রহমতুল মুনিম বলেন, আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া ও বর্ষার কারণে প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণ কিছুটা কমেছে। অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হবে এনবিআর।
রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আহরণ কাঙ্খিত না হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের এখন পর্যন্ত বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ব্যাংক নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ৪৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরেই এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও প্রভাব রয়েছে তা বাস্তবায়নের হারে। ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বা এডিপি বাস্তবায়ন কম। চলতি অর্থবছরের এই সময়ে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ২৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ২৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার আলোকেই ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে থাকে সরকার। রাজস্ব আহরণ কাঙ্গিত না হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিতে হয়।
এনবিআরের সক্ষমতা না বাড়িয়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় তা ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সিপিডি গবেষণা পরিচালক তৌফিক আহমেদ খান।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই এনবিআর ঘাটতিতে রয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ায় বিষয়টি বড় করে চোখে পড়ে না। তবে এবার চিত্র ভিন্ন। সরকার এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে। এটি ব্যক্তিখাতের ক্রেডিটের ক্ষেত্রৈ বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রাইভেট খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯.৯। যা যে কোনো সময়ের চেয়ে কম।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ এক লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। আর আয়কর খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এক লাখ ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি ১৬ লাখ ও শুল্ক খাতে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়।