কিস্তির টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তায় ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতারা
রাজধানীর চক বাজারের (সার্কুলার রোড) সারা এন্টারপ্রাইজের ইমিটেশন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম এবছরের শুরুতে ছয় লাখ টাকা ঋণ নেন। গতবছরের নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। স্থানীয় একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে নেয়া এই ঋণ এখন রীতিমতো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে সেকেন্ড ওয়েভের সংক্রমণ শুরুর আগ পর্যন্ত তার ব্যবসা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আবারও ব্যবসায় ধস নেমে আসে।
তিনি বলেন, "ব্যবসা খারাপ হওয়ায় গত দুই মাস ধরে ঘর ভাড়া দিতে পারিনা। এরমধ্যে দুই দিন আগে কিস্তির টাকা নিতে আসে। কিস্তি দেওয়া সম্ভব না জানালে, তারা বাগবিতণ্ডা শুরু করে।"
"বাসায় এমন পরিস্থিতির উত্তেজনায় মেয়ে হতবাক হয়ে কান্না শুরু করে,"
"কিস্তির বিষয়ে দোকানে কথা বলা যেত। মহামারির আগেও ঋণ নিয়েছি, সময় মতো পরিশোধও করেছি," আগে কখনো এমন হেনস্তার শিকার হননি জানান তিনি।
শুধু রাজধানীর নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও ঋণ গ্রহীতারা কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যবসায় গতি না থাকায় তারা রীতিমতো বিপাকে পড়েছেন। কোভিডের প্রথম ওয়েভ শেষে নেওয়া নতুন এই ঋণ এখন তাদের গলার কাঁটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা এব্যাপারে বলেন, "যদি সেকেন্ড ওয়েভ না আসতো তাহলে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়তো এমন অবস্থা হতো না। এখন যেহেতু তারা ব্যবসা করতে পারছে না, এসব ঋণের মেয়াদ বাড়ানো যায় কী-না তা নিয়ে ভাবতে হবে।
"তাছাড়া এমনও হতে পারে প্রণোদনার পাশাপাশি ছোট কিস্তিতে এসব ঋণ পরিশোধের সুযোগ তৈরি করা। এসএমই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে অবশ্যই সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা অব্যহত রাখতে হবে।"
তবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এমআরএ) বলছে, ঋণের কিস্তি নিয়ে গ্রহীতার সাথে সহনশীল আচরণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একই কথা বলেছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।
এদিকে ২ মে থেকে এমআরআই সীমিতভাবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, এমআরআই'র সনদপ্রাপ্ত আর্থিক সেবা প্রদানকারী ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম (নতুন ঋণ বিতরণ এবং রেমিটেন্স ও অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমূলক সেবা) স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারী অন্যান্য নির্দেশনা মেনে অনুমতি দেওয়া হলো।
এই সার্কুলারে নতুন ঋণ বিতরণের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও, কিস্তি আদায়ের ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি। তবে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়মিতভাবে ঋণের কিস্তি আদায় করছে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সব প্রতিষ্ঠান।
এমআরআই'র এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, "বিশেষত, গ্রামের মানুষের এখন টাকা দরকার। তারা ঘুরে দাঁড়াতে চায়। এজন্য সীমিত পরিসরে ঋণ বিতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখনো কিস্তি আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি।"
পিকেএসএফ'র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) ড. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, "মহামারির শুরুতে ঋণের কিস্তি নেওয়া বন্ধ ছিল। এরপরের সময়ে ঋণ গ্রহীতার কিস্তি পরিশোধে সর্বোচ্চ সহনশীলভাবে দেখানোর জন্য আমাদের অধীনে যে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদেরকে বলেছি।"
"এর মাঝেও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। বিশেষ করে মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ঋণ (দশ লক্ষ) যেগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো আদায়ে সমস্যা হচ্ছে। কারণ তাদের ব্যবসা ভালো না। কিন্তু এর পরেও আমরা এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে রিকভারি লোন দিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেছি।
স্বাভাবিক সময়ে বিতরণকৃত ঋণের ৯৮-৯৯ শতাংশ তোলা সম্ভব হলেও বর্তমানে এই হার ৯০ শতাংশের মতো বলে জানান তিনি।
কিস্তি পরিশোধে আবারও ঋণ
সিলেটের পোশাক ব্যবসায়ী মশিউর রহমান জানান স্থানীয় ঋণদান সংস্থা থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি।
"বৈশাখের পর ঈদের বেচাকেনাও তেমন হয়নি। এখন বেচাকেনা আরও কম," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
বর্তমানে ব্যবসার যে অবস্থা তাতে পরিবারের জন্য খাবার যোগানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
"সংসারের খরচ সামলিয়ে ঋণের কিস্তি দিতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কিস্তি দিতে উল্টো আবার ধার করতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
ক্ষুদ্র ঋণ কি মৃত্যু ফাঁদ?
এদিকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় উদ্বেগ বাড়ছে ব্যবসায়ী ও ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধের ঘটনা কেন্দ্র করে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, এ মাসের ১৭ তারিখে চাঁদপুরে সেলিম (৪৫) নামের এক অটোরিকশা চালক আত্মহত্যা করেন। কিস্তিতে কেনা অটোরিকশায় লকডাউনে আয় কম থাকায় কিস্তির টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তা থেকে আত্মহত্যা করেন তিনি।
এ মাসের ছয় তারিখে শরীয়তপুরের ডামুড্যায় ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন আরও একজন। বিশাকুড়ি চন্দ্রপাড়া ধীরেন চন্দ্র শীল (৫০) নামের এই নরসুন্দর কয়েকটি এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলন।
২৬ মে ঋণের কিস্তি না দিতে পারায় পাবনার চাটমোহর উপজেলার রেলবাজার এলাকায় মারধরের শিকার হন ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম (৩৫)। ব্যবসায় স্বচ্ছলতা ফেরাতে এক বছর আগে বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। করোনা সংকটে ব্যবসায় মন্দার কারণে কয়েকটি কিস্তি দিতে পারেননি তিনি।
এসব পরিস্থিতিতে ঋণ গ্রহীতা এবং ঋণের কিস্তি সংগ্রহকারী দুজনই মানসিক চাপে থাকেন বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
"মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা আমাদের দেশে অপ্রতুল। বিষয়টি আমাদের দেশে সেভাবে গুরুত্ব পায় না। যদিও বিষয়টির গুরুত্ব স্বাস্থ্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।"
এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।