চট্টগ্রামের বড় ঋণ খেলাপিদের উত্তরসূরিদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংকগুলো
চট্টগ্রাম ভিত্তিক শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের বংশধরেরা (সন্তান ও নাতি) আলাদা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা করছেন। কিন্তু, তাদের ঋণদানে উৎসাহী নয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। দ্বিতীয়বার খেলাপি ঋণের ঝুঁকি নিতে না চাওয়াই যার প্রধান কারণ।
চট্টগ্রামের এসএ গ্রুপ, বলাকা গ্রুপ এবং ইলিয়াস ব্রাদার্স- এই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে আধা ডজন ব্যাংকের। ঋণ আদায়ে আদালতের শরণাপন্নও হয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে প্রায় এক দশকের কাছাকাছি সময় ধরে মামলাগুলো আদালতেই স্থবির পড়ে আছে।
অন্যদিকে, এসব কোম্পানি মালিকের নতুন প্রজন্ম পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ব্যবহার করে নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাবা বা দাদার অফিস ও গুদামঘর সবই তারা ব্যবহার করছেন। তাই ব্যাংকাররা মনে করেন, নতুন করে ঋণ নিতেই আসলে আদি প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে চালু করা হয়েছে নতুন প্রতিষ্ঠান । এসব কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনে তাই বাড়তি সতর্কতা বজায় রাখছেন ব্যাংকাররা।
তবে নতুন ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের ব্যবসা আলাদা এবং একারণে আইনত তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাপ/দাদার আমলের ঋণের জন্য দায়ীও নয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি, ঋণ খেলাপির একই সম্পত্তি ব্যবহার করে নতুন ব্যবসা চালুর এ উদ্যোগ আইন প্রয়োগে বন্ধ করা উচিৎ। কারণ এসব ব্যবসায়ী খেলাপি ঋণের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পত্তি ব্যবহার করলেও, তার দায়ভার নিতে চান না।
শীর্ষ খেলাপি এসএ গ্রুপের ব্যবসা এখন মুসকানের নামে
দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একজন চট্টগ্রামভিত্তিক এসএ গ্রুপের মালিক শাহাবুদ্দিন আলম। তার কাছে ১৮টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
ঋণ আদায়ের জন্য শতাধিক মামলাও হয়েছে শাহাবুদ্দিন আলমের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন তিনি। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে তিনি নিজেকে আড়ালে করে ছেলেদেরকে সামনে রেখে গড়ে তোলেন 'মুসকান গ্রুপ'। এই গ্রুপের মালিক দেখানো হয়েছে শাহাবুদ্দিন আলমের বড় ছেলে সাজ্জাদ আরেফিনকে।
চট্টগ্রামের ব্যাংকাররা বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে যেসব প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে অন্যতম এসএ গ্রুপ। আগের ঋণ দায় এড়িয়ে; নতুন করে ব্যাংক ঋণ নেয়ার কৌশল হিসেবে 'মুসকান' নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি।
নতুন ঋণ পেতে মুসকান গ্রুপ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদনও করেছে। কিন্তু, চট্টগ্রামের ব্যাংকাররা নতুন ঝুঁকিতে পড়তে চাচ্ছেন না বলে এসব আবেদন অগ্রাহ্য করছেন।
উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক (বর্তমানে কুমিল্লার জোনাল হেড) মো. রফিক নেওয়াজ বলেন, এসএ গ্রুপ মুসকানের নাম দিয়ে নতুন ঋণ-প্রস্তাব দিয়েছিল। শাহাবুদ্দিন আলমের ছেলেকে মুসকানের স্বত্বাধিকারী হিসেবে দেখানো এই প্রস্তাব আমরা নাকচ করে দেই। আমরা নতুন কোনো ঝুঁকিতে পড়তে চাই না।'
মুসকান গ্রুপ আরো কয়েকটি ব্যাংকে একইভাবে ঋনের আবেদন করলেও, ব্যাংকগুলো তাতে সাড়া দিচ্ছে না। ব্যাংক এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিডিএ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হোসনেজ্জামান এসএ গ্রুপের মালিক শাহাবুদ্দিন আলমকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি উল্লেখ করে বলেন, ঋণের টাকা যে পরিশোধ করতে হয়, সেই মানসিকতাই নেই তার। তাই মুসকানকে ঋণ দেওয়া এসএ গ্রুপকে ঋণ দেয়ার মতোই সমান ঝুঁকিপূর্ণ।
এসএ গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা : ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৪৮১ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ৬০০ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৩৮ কোটি, ঢাকা ব্যাংকে ২৪৭ কোটি, পুবালী ব্যাংকে ২৮৮ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২২১ কোটি, জনতা ব্যাংকে ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ১৫১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ১১৮ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১০২ কোটি, কৃষি ব্যাংকে ১০০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ৫৩ কোটি, উত্তরা ব্যাংকে ৫২ কোটি, প্রাইম লিজিং-এ ৩৬ কোটি, কমার্স ব্যাংকে ২৩ কোটি, মাইডাস ফাইন্যান্সে ২২ কোটি এবং আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ১৪ কোটি টাকা।
এসএ গ্রুপের খেলাপি ঋণ পরিশোধ এবং ছেলের নামে গড়ে তোলা মুসকান গ্রুপ সম্পর্কে জানতে শাহাবুদ্দিন আলমের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বলাকা হয়েছে ড্রিম গ্রুপ:
চট্টগ্রামের ব্যাংক পাড়ায় বলাকা গ্রুপের মালিক নূর-উন-নবীর পরিচিতি 'ব্যাংক মারোয়া' (ব্যাংক মেরে দেওয়া) হিসেবে। তার কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৮০০ কোটি টাকার বেশি। এসব ঋণের দায় এড়াতেই নিজেকে আড়ালে রেখে ছেলে সাফাত বিন নবীকে দিয়ে 'ড্রিম গ্রুপ' তৈরি করে নূর-উন-নবীই ব্যবসা চালাচ্ছেন, বলে জানিয়েছেন পাওনাদার ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা।
ব্যাংকাররা বলেছেন, বলাকা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণ দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে 'ড্রিম গ্রুপ'। ব্যাংকের ফাইলে বলাকা গ্রুপের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে আগ্রাবাদ এলাকার নিব হাউজ। সেখানে এখন বলাকার পরিবর্তে ড্রিম গ্রুপের সাইনবোর্ড লাগানো। গার্মেন্টস, নিটিংসহ একাধিক খাতে ব্যবসা আছে নতুন এই গ্রুপের।
বিসিবির সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার হেড অব ব্রাঞ্চ মোহাম্মদ বেলাল বলেন, নূর-উন-নবী ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিশোধ করছেন না। কিন্তু, ছেলের মালিকানায় নতুন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের জোনাল হেড মো. কামাল উদ্দিন বলেন, বেশ কয়েকবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেও পাওনা পরিশোধ করেননি নূর-উন-নবী। এখন তার ছেলেকে দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ব্যবসা শুরু করেছেন।
নিটিং, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও ট্রাভেলসহ কয়েকটি খাত দিয়ে নব্বই দশক থেকে ব্যবসা শুরু নূর-উন-নবীর। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বলাকা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে একাধিক মামলাও করেছে ব্যাংকগুলো।
বলাকা গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১৫১ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ১২৮ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ১৭ কোটি টাকা এবং প্রিমিয়ার ব্যাংকে ১৬ কোটি টাকা।
এপ্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলাকা গ্রুপের মালিক নূর-উন-নবী বলেন, 'ব্যবসায় লোকসানের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ শোধ করতে পারিনি। আস্তে আস্তে শোধ করার চেষ্টা করছি।'
ড্রিম গ্রুপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বলাকা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে নেওয়া ঋণ ড্রিম গ্রুপে বিনিয়োগ করিনি। ড্রিম গ্রুপের মালিক আমার ছেলে সাফাত বিন নবী।'
ইলিয়াছ ব্রাদার্স এসেছে এমইবি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স নামে
ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় থাকা আরেকটি গ্রুপ চট্টগ্রামের মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এক সময় দেশে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় নেতৃত্ব দেয়া এই গ্রুপটির কাছে ১৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ে ব্রিটিশ আমল থেকে ব্যবসা শুরু করা এই গ্রুপটি।
এমইবি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স নামের নতুন গ্রুপ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন ইলিয়াছ ব্রাদার্সের মালিকদের তৃতীয় প্রজন্ম। নতুন গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইলিয়াছ ব্রাদার্সের মালিক মোহাম্মদ ইলিয়াসের নাতি শোয়েব রিয়াদ। উত্তরসূরিদের ব্যাংক ঋণের দায় নিতে নারাজ তিনি।
চট্টগ্রামের ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, শামসুল আলম, নুরুল আবছারসহ যারা ইলিয়াছ ব্রাদার্সের দ্বিতীয় প্রজন্ম, তাদের নামেই ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ খেলাপি ঋণ। এই ঋণ থেকে বর্তমান প্রজন্মও সুবিধাভোগী হয়েছেন। ঋণের টাকায় গড়ে তোলা সম্পত্তির উত্তারাধিকারীও তারা। ইলিয়াছ ব্রাদার্সের কার্যালয়, গোডাউন, কারখানা, ক্রয় করা ভূমিসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভোগ করছে এমইবি।
ভুক্তভোগী ব্যাংকারদের প্রশ্ন, ইলিয়াছ গ্রুপের সম্পত্তি ও সুনাম সব ব্যবহার করছে এমইবি গ্রুপ। তাহলে আগের খেলাপি ঋণের দায়- তারা নেবে না কেন?
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রামের জোনাল হেড জসিম উদ্দিন বলেন, দায় না নেয়ার বিষয়টি খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করার কূটকৌশল মাত্র।
এপ্রসঙ্গে এমইবির কর্নধার শোয়েব রিয়াদ বলেন, 'আমি তো ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেইনি। খেলাপি ঋণ সব বাপ-চাচাদের। ওই ঋণের দায় আমি কেন নেব?'
এমইবি বর্তমানে বিটুমিন আমদানিসহ কয়েকটি খাতে ব্যবসা পরিচালনা করছে। খাবার পানি, ভোজ্য তেল ও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা বন্ধ রাখা হয়েছে।
ইলিয়াছ ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণ: অগ্রণী ব্যাংকে ২৮০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৭০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৭৩ কোটি, এবি ব্যাংকে ৬২ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ৬৩ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৫ কোটি, সিটি ব্যাংকে ৫৫ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৯ কোটি, ওয়ান ব্যাংকে ৩০ কোটি, স্টান্ডার্ড ব্যাংকে ২৪ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮ কোটি, পুবালী ব্যাংকে ৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকে ৪ কোটি টাকা।