চট্টগ্রাম কাস্টমসের দুর্বল সাইবার নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রতারকচক্র
ব্যস্ততার জন্য যদি ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট করার সময় না পান, তাহলে কি আপনি নিজের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড অন্য কাউকে দিয়ে স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়ার কাজ করাবেন? নিশ্চয় দেবেন না।
অবশ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কয়েকজন কর্মকর্তা কিন্তু সানন্দে অননুমোদিত ব্যক্তিকে স্বয়ংক্রিয় রাজস্ব সফ্টওয়্যারের আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়ে দিয়েছেন। সফ্টওয়্যারটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিবহন কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হলেও, তারা প্রায়ই ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টদের দ্বারা বেষ্টিত থাকাকালে সিস্টেমে লগ ইন করে। এমনকি অফিসের বাইরে থেকেও সিস্টেমে সাইন ইন করে। যেসব কর্মকর্তারা আর চাকরিরত নেই, কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ তাদের তাদের আইডিও ডিঅ্যাক্টিভেট করে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরকম অবিবেচক মনোভাবের কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহার করে প্রতারণা ও শুল্ক ফাঁকির ঘটনা থামছে না। শুল্ক বিভাগের সফটওয়্যার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম-এ অনুপ্রবেশ করে প্রতারক চক্র আমদানি ও রপ্তানি পণ্য চালানে জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছে।
এর ফলে আমদানি পণ্য চালানে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে সরকারের আর্থিক প্রণোদনা আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে বারবার।
জনবল কাঠামোর তুলনায় কর্মকর্তার সংখ্যা অর্ধেক হওয়ায় অনুনোমোদিত ব্যক্তির কাছে ইউজার আইডি হস্তান্তর, লগইনের সময় আশপাশে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মীদের উপস্থিতি, কর্মস্থল পরিবর্তনের পরও আইডি বন্ধ না করা, অফিসের বাইরের যেকোনো আইপিতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বারবার একই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এছাড়াও সিস্টেম ত্রুটি, ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া এবং একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসের কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আমদানি-রপ্তানি পণ্যের চালান খালাসে শুল্কায়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম, বিশেষ করে বিল অভ এন্ট্রি দাখিল, পণ্য চালানের অ্যাসেসমেন্ট, কাস্টম ডিউটি পেমেন্ট, বন্দর থেকে ডেলিভারিসহ সব কাজে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এই সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের নিজস্ব ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড থাকে।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের শুল্কায়নে প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধ করতে গত ২৭ অক্টোবর দেশের সব শুল্ক স্টেশনসহ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে চালু হয় ওয়ান ওটিপি সিস্টেম। ওই সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের মাধ্যমে জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু ওটিপি সিস্টেম কোনো কাজে আসেনি।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহার করে প্রতারক চক্র আমদানি পণ্য খালাস করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। সরকারি আর্থিক প্রণোদনার জন্য রপ্তানি না করেও ভুয়া রপ্তানি দেখিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম গত ১৭ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্যকে (শুল্ক নীতি ও আইসিটি) একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লগ ইনের ক্ষেত্রে ওটিপি প্রদান নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক ইউজার ইচ্ছা করলে ওটিপি ছাড়াও অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লগ ইন করতে পারেন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, রাজস্ব আহরণে নানা ধরনের ঝুঁকি ও জালিয়াতির সম্ভাবনা রয়েই যাচ্ছে। শুল্কায়ন কার্যক্রমকে আরো গতিশীল, নিরাপদ ও জবাবদিহির আওতায় আনতে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লগ ইন করতে ওটিপি সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামুলক করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে। কিন্তু ইউজাররা এখনও ওটিপি ছাড়াই সিস্টেমে লগ ইন করে।
সম্প্রতি সরকারের আর্থিক প্রণোদনা আত্মসাতের জন্য ২৪টি রপ্তানি চালানে করা হয়েছে জালিয়াতি। পণ্য রপ্তানি না করেও কাগজপত্রে ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার আমের জুস, ড্রাই কেক, মসলা ও বিস্কুট রপ্তানি দেখানো হয়েছে। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে সরকার ২০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দেয়। ভুয়া রপ্তানির এসব চালানে সরকারের ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা প্রণোদনা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এই ঘটনায় রাজস্ব কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান সরকার এবং শাহ আলমের ইউজার আইডি ব্যবহার করা হয়। মাই ফুডস লিমিটেড, নাবিহা অ্যাগ্রো লিমিটেড এবং অলিভ সোর্সিং সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপে এসব পণ্যের রপ্তানি দেখানো হয়।
এই জালিয়াতির পর চট্টগ্রাম কাস্টমস চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে।
৪ বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত এক কাস্টমস কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮৫০ কোটি টাকার চার হাজার চালান খালাস করে নিয়ে গেছে এক জালিয়াত চক্র।
বদলি হওয়া আরেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে ৩ হাজার ৬৮১ বার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লগইন করার তথ্য উদঘাটন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘটা এমন জালিয়াতিতে সাত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আট কাস্টমস কর্মকর্তার যোগসাজশও পেয়েছে তারা।
চিটাগাং ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু বলেন, 'প্রতারণা ও জাল জালিয়াতি রোধে ওটিপি চালু আমাদের দাবি ছিল। এটা চালু হলে ইউজাররা কেউ বলতে পারবে না আমার পাসওয়ার্ড চুরি হয়েছে। তবে সিস্টেমে ত্রুটি থাকলে কোনোভাবেই এ উদ্যোগ সফল হবে না।'
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, 'ওটিপি সিস্টেম পুরোপুরি সচল হলে এসব জালিয়াতি হতে পারত না।'
জালিয়াতিতে যেসব কাস্টমস কর্মকর্তাদের আইডি ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া টিবিএসকে বলেন, 'প্রতি বছর এনবিআর অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার আপগ্রেড করে। এরপরও কিছু চক্র সফটওয়্যারে প্রবেশ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এই সফটওয়্যারের সিকিউরিটি পর্যায়ক্রমে আরো বাড়ানো হবে।'