চীনের বড় কোম্পানিগুলো চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায়, বেইজিংয়ের পরিকল্পনাও তাই!
বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে চলেছে চীন। সরকারের ইচ্ছেমতো নেওয়া পদক্ষেপের কারণে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে হারিয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি বাজারমূল্য। যে কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির বাজারে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে উদ্ভাবনার ভবিষ্যৎ।
বেইজিংয়ের এমন আগ্রাসী কৌশলের মূল লক্ষ্য অবশ্য বেসরকারি উদ্যোগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নয়, বরং সরকার এটাই প্রমাণ করতে চায়, শাসকগোষ্ঠী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে পুঁজিভিত্তিক বাজার ব্যবস্থার সুবিধা সকলেই গ্রহণ করতে পারবে। ব্যতিক্রম হলেই নেওয়া হবে ব্যবস্থা।
তবে সরকার বেশ কিছু কোম্পানির ওপর জরিমানা আরোপ ও তাদের পরিষেবার মোবাইল অ্যাপ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। কিছু কোম্পানির ব্যবসায়িক মডেলেও সম্পূর্ণ সংস্কার আনার দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
মুনাফাভিত্তিক শিক্ষাদান ও ফুড ডেলিভারি শিল্পের ওপর সাম্প্রতিক বিধিনিষেধ ঘোষণার পর, গেল সপ্তাহেও চীনের পুঁজিবাজারে শত শত কোটি ডলার মূল্যায়ন হারিয়ে গেছে এসব খাতের শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানি।
তবে বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে, বেসরকারি উদ্যোগ আরও নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সুরক্ষিতকরণ এবং নাগরিকদের অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষা করা হচ্ছে।
এছাড়া, কর্মীদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো, ডেটা প্রাইভেসি এবং শিক্ষা খাতে বৈষম্য দূরীকরণের মতো দীর্ঘদিন ধরে মাথাচাড়া দেওয়া ইস্যুগুলোর সমাধান করবে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ।
এ ব্যাপারে টেকসই বিশ্ববাণিজ্য নিয়ে কাজ করা হাইনরিখ ফাউন্ডেশনের গবেষণা ফেলো অ্যালেক্স ক্যাপ্রির মন্তব্য, 'বেসরকারি ব্যবসার ওপর চীনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো নিয়ন্ত্রণ। ভবিষ্যতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে ওঠা এবং অবাধ্য আচরণ নিরুৎসাহিত করাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে; কারণ এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠলে তা বেইজিংয়ের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক মডেলকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।'
করপোরেট ব্যবস্থায় বড় সংস্কার
বেইজিংয়ের সংস্কার অভিযানে নড়েচড়ে বসেছে চীনের করপোরেট জগত। সরকার প্রথমেই নজর দেয় প্রযুক্তি খাত নিয়ন্ত্রণে।
গত বছরের নভেম্বরে প্রথম ধাক্কা আসে অ্যান্ট গ্রুপের ওপর, এ সময় কোম্পানির আইপিও উদ্যোগকে আচমকা স্থগিতের ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আলি-পে পরিষেবার জন্য সুপরিচিত কোম্পানিটির পরিচালনা কার্যক্রমকে পরবর্তীকালে সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ফিন্যান্সিয়াল হোল্ডিং কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়।
এরপর প্রযুক্তি শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কোম্পানির কোনো না কোন ত্রুটি ধরতে থাকে কর্তৃপক্ষ। একচেটিয়া বাজার কায়েমের অভিযোগে আলিবাবা'কে ২৮০ কোটি ডলার জরিমানা করা হয়।
সামাজিক মাধ্যম ও গেমিং জায়ান্ট টেনসেট এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পিনডুওডোর বিরুদ্ধেও বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ওঠার পর কোম্পানিগুলো বড় কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
এছাড়া, মার্কিন পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর গত মাসের শুরুতে চীনের রাইড পরিষেবা জায়ান্ট ডিডি'কে অ্যাপ স্টোর থেকে ব্যান করা হয়।
মার্কিন বাজার অন্তর্ভুক্ত হওয়া অন্যান্য চীনা কোম্পানিকেও টার্গেট করে তাদের ডেটা সিকিউরিটি নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
সবশেষ গত ২৪ জুলাই শিক্ষা ও প্রাইভেট টিউশনভিত্তিক অনলাইন পরিষেবার কোম্পানিগুলোর ওপর মুনাফা অর্জন ও পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বেইজিং। নাটকীয় এমন সিদ্ধান্তের ফলে এ খাতের অধিকাংশ বড় কোম্পানিকে এখন তাদের সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তন করা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
এ নিয়ে গত সপ্তাহে বৃহৎ মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের এক গবেষণা নোটে বলা হয়, 'সাম্প্রতিক দমন অভিযান- সময়কাল, তীব্রতা, সুযোগ এবং নতুন নীতি ঘোষণার বেগের দিক থেকে নজিরবিহীন।' এসব পদক্ষেপকে 'সমাজতন্ত্রী ও পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার মধ্যে পুনঃভারসাম্য' প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা হয় সেখানে।
গোল্ডম্যানের অর্থনীতিবিদরা জানান, পুঁজিবাজারের চেয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ সামাজিক কল্যাণ ও সম্পদের পুনঃবণ্টনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
কঠোর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অহেতুক নয়
তবে চীনের সাম্প্রতিক কঠোর পদক্ষেপগুলোর পেছনে সত্যিকার অর্থেই জনকল্যাণের উদ্দেশ্য রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন বিশ্লেষকরাও।
যেমন ব্যবহারকারীদের স্পর্শকাতর ও অতি-গোপনীয় তথ্য সংরক্ষণে ডিডিসহ বেশ কিছু কোম্পানি অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
দীর্ঘদিন ধরেই চীনা নাগরিকরা এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন। আরও অভিযোগ ছিল বাণিজ্যিক নজরদারির।
অনলাইনের বেসরকারি শিক্ষার সুবিধাও সকলে নিতে না পারায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়, যা নিরসনে এখন সংস্কার চালু করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে মুনাফাভিত্তিক প্রাইভেট টিউশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় চীনা কর্তৃপক্ষ বলে, শিক্ষার এ সুযোগ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা 'হাইজ্যাক' করেছে, ফলে 'শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বিকৃত করা হচ্ছে।'
সরকারি বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে ইতালির বোক্কোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোঞ্জা অপ্পার বলেন, 'বৈষম্য নিরসনে মনোযোগ দেওয়া বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। আয় ও শিক্ষায় অসমতা বিষয়ে জনগণের উদ্বেগ দূরীকরণে এটি ভূমিকা রাখতে পারবে।'
-
সূত্র: সিএনএন