জাহাজে বৈশ্বিক কার্গো পরিবহনের সংকটে প্রভাবিত হবে বড়দিনের কেনাকাটা
যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরের ডিসেম্বরে বড়দিন উদযাপন করেন খ্রিস্ট ধর্মালম্বীরা। অধিকাংশ উন্নত দেশে এ ধর্ম প্রধান হওয়ায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য থাকে ক্রিসমাসে বিশাল কেনাকাটার বাজার ধরার। দেওয়া হয় পণ্য অর্ডারে বিশাল মূল্যছাড়সহ অন্যান্য আকর্ষণীয় সুবিধা। তাই এতে অন্যান্য মতাদর্শের বৈশ্বিক ক্রেতারাও যুক্ত হন। তবে এ বছর হয়তো মহামারির কারণে আগেই বড়দিনের কেনাকাটা শুরু করতে হবে তাদের।
কারণ, বিশ্বব্যাপী বাড়ছে জাহাজে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব, সঙ্গে পরিবহন খরচও নিয়েছে আকাশছোঁয়া মাত্রা। এ পরিস্থিতির উন্নতি দূরে থাক, বরং দিন দিন আরও নাজুক হচ্ছে বাণিজ্যের এ দিকটি।
মহামারির মধ্যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধিসহ কন্টেইনার (পণ্য ধারক) সংকটে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র বাধাগ্রস্ত হয়। তার সঙ্গে পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে এশিয়া থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রপ্তানি বাণিজ্যের একমুখী গতি এবং গেল মার্চে সুয়েজ খালে বিশাল কন্টেইনারবাহী জাহাজ এভারগিভেনের এক সপ্তাহ আটকে থাকার ঘটনা তাতে অবনতি যোগ করে শুধু।
আলোচিত ঘটনাগুলো এখনও সমস্যার সৃষ্টি করে চললেও তার সঙ্গে নতুন এক বিপত্তিও যোগ হয়েছে- যা এমনকি বড়দিনের কেনাকাটা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। বিপদের কেন্দ্রে আছে চীনের 'ফ্যাক্টরি বেল্ট' খ্যাত ইয়ানতিয়ান বন্দর এলাকায় ভাইরাসের নয়া প্রাদুর্ভাব। প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চলতি জুন থেকেই এ অঞ্চলের কারখানাগুলো আংশিকরূপে শাটডাউনের কবলে পড়ে। এ অবস্থায় জাহাজে পণ্য পরিবহনের শিল্পে অবশিষ্ট যেটুকু অতিরিক্ত সক্ষমতা ছিল তাও হ্রাস পাচ্ছে প্রতিদিন। অথচ, কন্টেইনারে পণ্য পরিবহনের শিল্প প্রতিবছর ৪ লাখ কোটি ডলারের পণ্য পরিবহনে যুক্ত। যার অচলাবস্থা নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
"সরবরাহ চক্রে বাঁধার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাটিই সবচেয়ে খারাপ," এ মন্তব্য করেন চীনের শেনঝেনে অবস্থিত বাণিজ্যিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কো.- এর শাখা অফিসের অংশীদার স্টিভ স্যাক্সন। ইয়ানতিয়ান বন্দর এলাকা সচল হতে একমাস সময় লাগতে পারে বলেই অনুমান করছেন তিনি, যার ফলে আশেপাশের অন্যান্য বন্দরেও অচলাবস্থা দেখা দেবে।
আগস্ট থেকেই বৈশ্বিক খুচরা পণ্য বিক্রেতারা তাদের গুদামে বড়দিনের জন্য পণ্য মজুদ শুরু করেন। কিন্তু বন্দরে অচলাবস্থার অর্থ- কন্টেইনার শিপিংয়ে খরচ বর্তমানের আকাশছোঁয়া অবস্থানেই থাকবে, এমনকি পণ্য সম্ভার পুনঃসজ্জার সর্বোচ্চ মৌসুম আগস্ট পর্যন্ত দেরীর দিকে এগিয়ে চলেছে পরিস্থিতি।
স্যাক্সন বলেন, "এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরাও ঘাবড়ে গেছেন। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে গিয়ে জাহাজে পণ্য পরিবহনের জায়গা পাওয়া যাবে কিনা- তা নিয়ে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে ততটুকু আগাম শিপিং ক্যাপাসিটির বুকিং দিচ্ছেন।
স্যাক্সন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা চাহিদা চলতি বছর জুড়েই শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। কিন্তু, এখনও সচল হতে না পারা সরবরাহের মূল উৎস সে চাহিদা পূরণ করতে পারবে কিনা- সেটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
"সুয়েজ খালে জাহাজ আটকে থাকার মতো আরেকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার আভাস দিতে চাই না। তবে কোভিডের কারণে আরও একটি বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সক্ষমতা হ্রাস অবশ্যই প্রতীয়মান।"
এ বাস্তবতায় চলতি বছরের বাকি অর্ধেক জুড়ে জাহাজে পণ্য পরিবহন শিল্প যেসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণণা দেওয়া হলো;
জাহাজ জট
বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পরও যখন পণ্য জটের কারণে মালামাল লোড-আনলোড করতে পারে না তখনই দেখা দেয় বড় সমস্যা- জাহাজ জট। এ অবস্থায় শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ জোড়া বন্দর লস অ্যাঞ্জেলস ও লং বিচ পড়েছে তাই নয়, পোতাশ্রয়ে নোঙ্গর ফেলে অপেক্ষমাণ দীর্ঘ জাহাজের সারি দেখা যাচ্ছে সিঙ্গাপুর থেকে জর্জিয়ার সাভানা পর্যন্ত সবখানেই। এমনকি একমুখী পণ্য প্রবাহের চাপ মোকাবিলায় জট দেখা দিয়েছে ইউরোপের প্রধান বন্দর হামবুর্গ, লিভারপুল ও রটারড্যামেও। ইয়ানতিয়ান বন্দরে সাড় বেঁধে পণ্য লোডের অপেক্ষা করছে এক ডজন জাহাজ। একটি সূত্রের অনুমান, সেখানে প্রায় ৪ লাখ কন্টেইনার জাহাজে বোঝাইকরণ স্থবির হয়ে পড়েছে।
ইয়ানতিয়ান বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলেও কোপেনহেগেন ভিত্তিক সি-ইন্টেলিজেন্স সংস্থার অ্যালান মার্ফির মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থবিরতার ঝাঁকুনি সমগ্র বিশ্ব জুড়ে অনুভব করা যাবে। "সত্যিকার অর্থেই দক্ষিণ চীনে লাখ লাখ কন্টেইনারের স্তূপ জমেছে, দেশটির অন্যান্য বন্দরও তাদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় কাজ করছে। তার ওপর আমরা জাহাজে খালি জায়গা এবং কন্টেইনার সংকট উভয়ই লক্ষ্য করছি। দক্ষিণ চীনের বন্দরের পরিস্থিতি ক্রমশ ধারাবাহিক সরবরাহ বিচ্ছিন্নতায় রূপ নিচ্ছে।"
কন্টেইনার মূল্য
রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া কন্টেইনার ভাড়া আরও বেড়েই চলেছে। চলতি মাসে জার্মানির হ্যাপাগ- লয়েড এজি'র দেওয়া নোটিশ এ দিকটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সেখানে সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী ১৮ জুলাই থেকে পূর্ব এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাগামী ২০ ফুটি কন্টেইনারে পিক সিজনের সারচার্জসহ আরও দুই হাজার ডলার ভাড়া দিতে হবে। বাড়তি এই মূল্য ২০১৯ সালে আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে কন্টেইনার প্রতি ভাড়ার চাইতেও বেশি।
ভাড়া বৃদ্ধির প্রধান কারণ আকর্ষণীয় এই বাণিজ্য রুটে চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত কন্টেইনার নেই। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃউন্মুক্তকরণ শুরু হওয়ায় মূল ঘাটতি দেখা দিয়েছে এশিয়ায়। এই ঘাটতি আরও বহুগুণে উন্নীত হতে পারে।
স্টিভ স্যাক্সন জানান, "সক্ষমতার এই অভাব থেকে ইউরোপও মুক্তি পাবে না।"
সংকট কাটাতে শিপিং লাইনগুলো লাখ লাখ নতুন কন্টেইনার ক্রয়ের অর্ডার দেওয়াসহ তাদের সমস্ত সম্পদ নিয়োজিত করলেও, সেগুলো চাহিদার তুলনায় অনেক ধীর গতিতে হাতে আসছে। তার সঙ্গে বন্দরগুলো অতিরিক্ত সক্ষমতায় পরিচালিত না হলে সামগ্রিক অচলাবস্থা কাটবে না বলেও মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ