জীবন বীমার এফডিআর পরিশোধে আরও ৯ বছর সময় চায় পদ্মা ব্যাংক
রাষ্ট্রীয় সংস্থা- জীবন বীমা করপোরেশনের জমা রাখা সাতটি মেয়াদোত্তীর্ণ আমানতের পাওনা ১০৯ কোটি টাকা ২০২৩ সাল থেকে সাত বছর ধরে পরিশোধ করার প্রস্তাব করেছে বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড। এই সময়ে ৬ শতাংশ হারে নিয়মিত সুদ পরিশোধ করে যাবে পদ্মা ব্যাংক।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসা নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে এক হাজার ২১৫ কোটি টাকার মূলধন সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ায় সরকারি চার ব্যাংক-সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও সরকারের বিনিয়োগ সংস্থা- ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নাম পরিবর্তন করে 'পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড' নামে যাত্রা শুরু করলেও পাওনা পরিশোধ করার মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই ব্যাংকটির। ২০১৮ সালের আগস্টে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব আমানতের সুদাসল পরিশোধের জন্য গত মার্চ পর্যন্ত ২৬টি তাগাদাপত্র ও ৫টি আধা-সরকারি চিঠি দেওয়া হলেও পাওনা পরিশোধ করেনি ব্যাংকটি।
গত ২২ জুন জীবন বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জহুরুল হককে এক চিঠি লিখে মেয়াদোত্তীর্ণ এফডিআরগুলোকে ৬ শতাংশ সুদে নবায়ন করার প্রস্তাব করে ২০২৯ সাল পর্যন্ত সুদাসল পরিশোধ করার প্রস্তাব করেন ব্যাংকটির এমডি এহসান খসরু। তাতে ২০২৩ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছর ধরে প্রিন্সিপাল পেমেন্ট প্ল্যান ও ৬ শতাংশ সুদে ইন্টারেস্ট পেমেন্ট প্ল্যানও করপোরেশনকে দিয়েছে ব্যাংকটি।
জীবন বীমা করপোরেশনের এমডি মো. জহুরুল হক বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মন্দের ভালো' হিসেবে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব আমরা মেনে নিয়েছি। যেহেতু তারা টাকা দিতে পারছে না, সেক্ষেত্রে টাকা আদায় করতে আমাদের মামলা করতে হতো। মামলা করে টাকা আদায় করাও সময়ের ব্যাপার।
তিনি বলেন, পদ্মা ব্যাংকের এমডি আমার কাছে এসেছিলেন, পরে লিখিতভাবে পেমেন্ট পরিকল্পনাসহ প্রস্তাব দিয়েছেন। পদ্মা ব্যাংক কনস্ট্রাকশন পর্যায়ে রয়েছে এবং টাকা ফেরত দিতে পারছে না বলে জানিয়ে এফডিআর নবায়নের প্রস্তাব করে।
'পদ্মা ব্যাংক থেকে টাকা আদায় করে তা আমরা হয়তো অন্য কোন ব্যাংকে রাখতাম। সেক্ষেত্রেও আমরা ৬ শতাংশ ইন্টারেস্টই পেতাম। ব্যাংকটি তাদের সংকটের কথা জানিয়ে ৬ শতাংশ ইন্টারেস্টসহ সুদাসল পরিশোধের একটি পরিকল্পনা লিখিতভাবে জানিয়েছে। ব্যাংকের প্রস্তাব করপোরেশনের ইনভেস্টমেন্ট কমিটিতে উপস্থাপন করা হলে, কমিটি 'মন্দের ভালো' হিসেবে ওই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে'- জানান তিনি।
তিনি বলেন, শুরুতে তারা আরও কম ইন্টারেস্ট দেওয়ার কথা বলেছিল। আমি তাদের বলেছি, সরকার নির্ধারিত আমানতের রেট ৬ শতাংশ। ওই হারে ইন্টারেস্ট দিতে হবে। পরে তাতে সম্মতি জানিয়ে লিখিতভাবে প্রস্তাব দিয়েছে তারা। পদ্মা ব্যাংকের সুরক্ষায় রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংক ও আইসিবি সহায়তা করেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানাও রয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করেছে করপোরেশন।
গত ২২ জুন জীবন বীমা করপোরেশনকে লেখা চিঠিতে এহসান খসরু বলেছেন, "নভেল করোনাভাইরাস মহামারি দেশে সর্বস্তরে জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে ব্যাহত করেছে। যেকারণে পদ্মা ব্যাংকও গুরুতর আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ বাস্তবতায়- গত ১৬ জুন আপনার দপ্তরের সঙ্গে আমাদের যে বৈঠক হয়েছে; সে অনুসারে আমরা জানাতে চাই যে, বর্তমানে আমরা এফডিআর- এর প্রিন্সিপাল এমাউন্ট ২০২৩ অর্থবছরের আগে রিফান্ড করার মতো অবস্থায় নেই। তবে এফডিআরের বর্তমান ম্যাচিউরিটি টার্ম অনুসারে আমরা আগের মতোই সুদ পরিশোধ অব্যাহত রাখব। একইসঙ্গে, ২০২০ সাল থেকে এক বছর মেয়াদি এফডিআরগুলোকে ৬ শতাংশ সুদহারে চলমান রাখার অনুরোধ করছি।" `
পদ্মা ব্যাংকের এমডি ওই চিঠিতে বলেছেন, আমরা আপনার প্রতিষ্ঠানের এফডিআরের প্রিন্সিপাল এমাউন্ট ২০২৩ সাল থেকে বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারব বলে আশা করছি। ব্যবসার ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি সম্ভবনা থেকেই আমরা এমনটা আশা করছি। সে অনুসারে পরিশোধের পরিকল্পনা তুলে ধরছি।
২০২৯ সাল পর্যন্ত সুদ ও আসল পরিশোধের পরিকল্পনা তুলে ধরে পদ্মা ব্যাংক লিখেছে, ২০২১ সাল থেকে ম্যাচিউরড হওয়া শুরু করলে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ সম্পূর্ণরূপে শোধ করা হবে। আর প্রিন্সিপাল এমাউন্টের অর্থ ২০২৩ সাল থেকে প্রতিবছর একটি ফিক্সড ডিপোজিট পরিশোধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। ২০২৩ সাল থেকে স্থায়ী আমানত পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রতিবছর আমরা একটি ফিক্সড ডিপোজিট হিসাব করে প্রতি প্রান্তিকে ২৫ শতাংশ প্রিন্সিপাল এমাউন্ট শোধ করব। এভাবে আমরা বছরে শতভাগ বা সম্পূর্ণরূপে একটি ফিক্সড ডিপোজিটের অর্থ শোধ করব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪-২০১৫ সালে পদ্মা ব্যাংকের মিরপুর শাখায় ৩৫.৬৩ কোটি টাকার দু'টি, মতিঝিল শাখায় ৪০.৫৬ কোটি টাকার তিনটি এবং গুলশান করপোরেট শাখায় ৩১.৯০ কোটি টাকার দু'টি মেয়াদি আমানতে মোট ১০৯.০৮ কোটি টাকা রাখে জীবন বীমা করপোরেশন। এসব এফডিআরের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালের আগস্টে। মেয়াদ শেষে জীবন বীমা করপোরেশনের বারবার তাগাদা সত্বেও পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড প্রিন্সিপাল আমাউন্ট ফেরত না দিলেও শুরু থেকে এ পর্যন্ত সুদ বাবদ ৪৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নতুন নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।
ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে আমানত নেওয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
এরপরই মূলত ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেওয়া শুরু হয়। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন সাবেক স্বরাষ্ট্র ও পরিকল্পনামন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়।
এরপর ১৯ ডিসেম্বর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ বিতরণে জালিয়াতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে, যা বিচারাধীন রয়েছে।