জুম ফসলে ভালো ফলন, আগ্রহ বাড়ছে ফলের বাণিজ্যিক চাষেও
বান্দরবানে সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এখন সোনালি রঙের পাকা জুমধান। মৌ মৌ গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিক। সে জুমধান কাটার ধুম পড়েছে সবখানে। সম্পূর্ণ প্রকৃতির আবহাওয়ায় নির্ভর সনাতন পদ্ধতির এ চাষাবাদে এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভাল হয়েছে জানিয়েছেন চাষীরা।
পাহাড়ি জমিতে মার্চে জঙ্গল পুড়িয়ে এপ্রিলে রোপণ করা ধান, পেকে উঠে ভাদ্র মাসে। চার মাস উদয়াস্ত পরিশ্রমের পর এখন জুমক্ষেতে ধান কাটার ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। নতুন ধান ঘরে উঠার এই সময়ে আনন্দের শেষ নেই জুমিয়া পরিবারের। এরপর কেউ কেউ নিজেদের মত পালন করেন নবান্নের উৎসবও।
বান্দরবান সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সম্প্রতি চিম্বুক পাহাড়ে যামিনী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি জুমক্ষেতে জুমধান কাটছিলেন চারজন ম্রো নারী। সবার পিঠে রয়েছে কাটা ধান জমা করার একটি করে থুরুং (ঝুড়ি)।
ধান কাটতে কাটতে জুমচাষী চামপয় ম্রো বলেন, "তিন হাঁড়ি (এক হাঁড়ি ১০ কেজি) বীজ ধান লাগানো হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ফলন ভাল হয়েছে। আবহাওয়া ভাল ছিল। ছেলেমেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসারে বছর খোরাকি ধান পাওয়া যাবে"।
''তবে জুমে শুধু ধান পাওয়া যায় না। তরকারি ও বিভিন্ন সবজি পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, আখ, তুলা, তিল, ঢেঁড়স, বেগুন আরও বিভিন্ন ফসল পাওয়া যায়। একটা জুমক্ষেত থাকলে বাজার থেকে তেল ও লবণ ছাড়া আর কিছুই কিনতে হয় না।''
অপর দুই জুমচাষী লেংপাউ ম্রো ও তাইলেং ম্রো বলেন, "চারজন জুমচাষী তিন দিন ধরে কাটছি। আরও দুদিন হলে কাটা শেষ হয়ে যাবে। এ বছর ফলন নিয়ে সন্তুষ্ট"।
''তবে চিম্বুক পাহাড়ে আগে যে পরিমাণে জুমচাষ হত এখন তা কমে আসছে। আম, পেঁপে ও বিভিন্ন জাতের কুলসহ লাভজনক ফসলের বাগান করছেন অনেকেই। তবে জুমক্ষেতে এক সাথে অনেক ফসল পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ এখনও জুমচাষ করে যাচ্ছেন।''
সম্প্রতি রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে মং খুমী পাড়ায় গিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে কথা হয় কয়েকজন জুমচাষীর সঙ্গে।
এ পাড়ার বাসিন্দা অংলে খুমী নামে এক জুমচাষী জানান, "পাড়ার পাশেই একটা ঢালু জায়গায় তিনিও ৩ হাঁড়ি ধান জুমচাষ করেছেন। অর্ধেক ধান পেকেছে। অর্ধেক পাকেনি। জুমে মিশ্র ফলসগুলোও ভাল হয়েছে"।
তবে বড় আকারে জুম এবং ফলন ভাল হলেও ধান কম পাওয়ার আশঙ্কা করছেন দুজন অপর জুমচাষী। তারা জানিয়েছেন, বুনো শুকরের পাল এবং বানরের দল পাকা ধান ও ক্ষেতের ফসল নষ্ট করছে।
নাংলু খুমী ও লেংপা খুমী নামে এই দুজন জুমচাষী বলেন, "পাড়া থেকে অনেক দূরে একেকজনে পাঁচ হাড়ি ধান করে জুমচাষ করেছে। ফলনও ভাল এসেছে। ধান পাকতে শুরু করেছে- এমন সময় বুনো শুকরের পাল এবং বানরের দল এসে ধান নষ্ট করছে। জুমঘরে থেকে সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়ে রাখতে হয়"।
এদিকে জুমে উৎপাদন হওয়া স্থানীয় ফসল সংগ্রহ করে বিক্রি করে আসছেন শহরের মধ্যমপাড়া মারমা বাজারে পাইকার ব্যবসায়ী হাসান ও শুক্কুর আলী।
তারা জানান, সাপ্তাহিক বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে জুমচাষীরা জুমের চাল বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। তখন তাদের থেকে সংগ্রহ করে সারাবছর বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে বিন্নি চাল বেশি বিক্রি হয়।
''বর্তমানে বিন্নি চাল ১২০ টাকা, তিল ১৬০ টাকা এবং কাঁকন চাল ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে জুমের নতুন চাল বাজারে আসলে এগুলোর দাম কিছুটা কমবে। বিন্নি চাল স্থানীয়দের পাশপাশি পর্যটকরা বেশি কিনে থাকে।''
জুমের বিন্নি চালের চাহিদা আছে ঢাকায়ও। জুমের অন্য চালও নিয়মিত বিক্রি হয় ঢাকার বেশ কিছু দোকানে। এর মধ্যে পাহাড় থেকে নিয়মিত চাল সংগ্রহ করে বিক্রি করে পান্থপথের মাদল এবং মোহাম্মদপুরের প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এম এম শাহ নেওয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, জুমচাষ প্রাকৃতিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। এপ্রিলে এক পশলা বৃষ্টির পর জুমক্ষেত প্রস্তুত করা হয় এবং বিভিন্ন বীজ বপন করা শুরু করেন জুমিয়ারা।
''এ বছর দেরিতে বৃষ্টিপাত হলেও নিয়মিত ব্যবধানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে জুমের ফলন এবং বিভিন্ন ফসল ভাল হয়েছে। এখন পুরোদমে জুমের ধান কাটা চলছে। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আরও বিভিন্ন ফসল সংগ্রহ করা হচ্ছে।''
মোটামুটি সবারই বছর খোরাকি ধান উঠবে। সব মিলিয়ে জেলার সব জায়গা থেকে জুমধানের ফলন ভাল হওয়ার খবর পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এ বছর সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে জুমচাষের আবাদ হয়েছে জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান। তবে দিন দিন জুমের উপযোগী পাহাড় কমে যাচ্ছে। এক বছর এক পাহাড়ে জুমচাষের পর আবার একই পাহাড়ে ঘুরে আসতে হয়। মাটির উর্বরতার জন্য মাঝখানে কয়েক বছর বিরতি দেওয়ার সুযোগ থাকছে না।
''তাতে করে পাহাড়ে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছাড়া উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন ফসলের উফসী জাতগুলো প্রচলনের চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে অল্প জমিতে উৎপাদন বেশি থাকে।''