পাহাড়ে জুমধান: ফলন নিয়ে কেউ খুশি, কেউ অখুশি!
এখনও পুরোদমে জুমধান কাটা চলছে পাহাড়ে। বিশেষ করে দেরিতে করে যারা ধান লাগিয়েছেন, তাদের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে শেষ মুহূর্তে। চাষিদের মতে, এ বছর আবহাওয়া এবং এলাকাভেদে ফলন কোথাও ভাল হয়েছে, কোথাও বা কম।
সম্প্রতি রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি পাহাড়ের পাদদেশে পাশাপাশি বিশাল তিনটি জুমখেত। ধান পেকে সোনালি রং ধারণ করেছে প্রায়। একটি খেতে ধান কাটা শেষে মাড়াইয়ের কাজ চলছে। একটিতে কাটা শুরু হয়েছে মাত্র। আরেকটিতে ধান তখনও অর্ধেক কাঁচা, অর্ধেক পাকা; আর কয়েক দিন পর কাটা শুরু হবে।
একটি জুমঘরে গিয়ে দেখা যায়, একপাশে কাটা ধানের স্তূপ। আরেকপাশে মাচাংয়ের ওপর ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে। পাশাপাশি মাড়াই শেষে ছড়িয়ে দিয়ে শুকানো হচ্ছে ধান। এরপর বস্তায় করে ভরে রাখা হচ্ছে জুমের ধান। সব ধান মাড়াই শেষে বস্তায় করে নিয়ে যাওয়া হবে ঘরে।
কাজ করতে করতে ব্যস্ত জুমচাষি অংথোয়াই মারমা জানান, ধান মোটামুটি ভাল হয়েছে। দুই আঁড়ি ধান লাগানো হয়েছিল। সব মিলে ১৪০ থেকে ১৫০ আঁড়ি ধান পাওয়া যাবে (এক আঁড়িতে ৬ কেজি চাল পাওয়া যায়)। ভুট্টা কম ধরেছে। তবে মারফা ভাল হয়েছে। মাঝখানে বেশি রোদের কারণে মরিচের গাছ মরে গেছে। কোনোরকমে খাওয়ার মত পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, 'তিল ও হলুদ ভালো হয়েছে। যতটা ধান মোটামুটি ভাল হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ভাল হয়েছে হলুদ।'
পাশে আরেকটি বিশাল জুমখেতে ধান কাটা শুরু হয়েছে মাত্র। বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনালি রঙের পাকা ধান। ঢুকতেই চারপাশে পাকা ধানের ম ম গন্ধ। সেখানেও ধানের চাইতে হলুদ আর তিল বেশি দেখা যায়। অন্যান্য সাথী ফসল মারফা, ভুট্টা, মরিচ ও মিষ্টিকুমড়া একেবারে নাই বললেও চলে।
খেতের মালিক গরামং মারমা টিবিএসকে বলেন, 'গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময় গরু ঢুকে সাথী ফসলের গাছগুলো সব খেয়ে ফেলেছে। এখন ধান, হলৃদ ও তিল ছাড়া অন্য কোন ফসল নেই। এটি চার আঁড়ি ধানের ক্ষেত। আমরা দুজন এই ধান কাটতে পনেরো দিনের মত লাগবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ধান ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি; এজন্য একটু কম পাওয়া যাবে। ভুট্টা ও মারফা খাওয়ার মতোও পাওয়া যায়নি। তারপরও ছয়জনের পরিবারে কোনোরকমে বছরের খোরাকি ধান উঠবে মনে হয়।'
তবে ধান ঘরে তোলার সময় কয়েক হাজার টাকা খরচ হবে জানিয়ে গরামং মারমা বলেন, 'মাড়াইয়ের পর ধান ঘরে নিয়ে যাবার সময় পাড়া থেকে লোকজন নিয়ে এসে এক আঁড়ি ধান ৬০ টাকা করে দিতে হবে। এটি আমাদের জন্য বাড়তি চাপ। অন্যান্য ফলস বিক্রি করে যেটুকু লাভ হয় সেগুলো ঘরে ধান তোলার কাজেই চলে যায়। এজন্য জুমচাষ করেও এত লাভ নেই।'
তবে দাম বাড়তি থাকলে হলুদ থেকে লাভ করা যাবে বলে জানান তিনি। বললেন, 'পাঁচ-ছয় মণ কাঁচা হলুদ সিদ্ধ করলে এক মণ শুকনো হলুদ পাওয়া যায়। গত বছর ১৫-১৬ মণ শুকনো হলুদ পাওয়া গেছে। মণপ্রতি ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।'
এ বছর গতবারের চেয়ে বেশি শুকনো হলুদ পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তিনি।
৫০ বছর ধরে জুমচাষের জীবন
পাড়া বা লোকালয় থেকে একদম দূরে জুমের খেতগুলো। কোথাও একবেলা হেঁটে যেতে হয়, কোথাও কয়েক ঘণ্টা। এজন্য বেশি দূরের খেতে প্রায় বছরখানেকের মতো বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় কোনো কোনো পরিবারকে।
ধান কাটা ও মাড়াই শেষে একেবারে ফসল ঘরে তোলার পরে তবেই ফিরতে পারে নিজ ঘরে। আবার পাড়া থেকে পায়েহাঁটা দূরত্বের জুমখেতে চাষিরা এক-দেড় মাস পরপর প্রয়োজন হলে ঘরে চলে আসতে পারে। তারপরও এপ্রিল-মে মাসে ধান লাগানোর পর থেকে বিভিন্ন কাজে জুমে লেগে থাকতে হয় তাদের।
৫০ বছর ধরে জুমচাষ করে আসছেন গরামং মারমা। জুমচাষের জীবন তুলে ধরে তিনি টিবিএসকে বলেন, '১৫ বছর বয়স থেকে বাবা-মার সঙ্গে জুমচাষ করছি। পাহাড়ে সমতল ধানি জমি না থাকায় সেই জুমচাষকেই বেছে নিতে হয়েছে বড় হয়ে। গত বছর জানুয়ারি-ফেবুয়ারি থেকে জঙ্গল কাটার শুরু করেছি। তখন থেকেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে জুমঘরও তৈরি করেছি। এবার ঘটনাচক্রে তিন জুমচাষি পরিবার পাশাপাশি থাকছি। এর আগে যত জুমচাষ করেছি স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ এক পরিবার ছাড়া কেউ ছিল না।
'ছোটকাল থেকে এরকম বনজঙ্গলে জুমচাষ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিপদ-আপদের কথা ভেবে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে একসঙ্গে থেকেছি। কোনো সময় চাল-লবণ লাগলে এক মাসের মত খোরাকির জন্য পাড়ায় গিয়ে নিয়ে আসি। তখন এক-দুদিন পাড়ায় থেকে আসা হয়।'
তিনি বলেন, 'সামনে বছর পাড়ার কাছেই একটা জায়গায় জুম করব। দূরে গিয়ে আর করব না। বয়সও হয়ে যাচ্ছে। এরপর পাড়ায় ঘরের পাশেই ছোটখাটো সবজিখেত করে বাকি জীবনটা কাটাব।'
জুম চাষ কী
পাহাড়ে পাদদেশে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে জঙ্গল কাটা শুরু হয়। কাটা জঙ্গল শুকানোর পর ফায়ার লাইন করে পুড়ানো হয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ধানের বীজ ও অন্যান্য সাথী ফসলের বীজ গর্ত করে বপন করা হয়।
সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়ে এই চাষাবাদকে জুমচাষ বলা হয়ে থাকে। তবে একই পাহাড়ের একই মাটিতে বারবার জুম চাষ করা যায় না। মাঝখানে ন্যুনতম তিন থেকে চার বছর বিরতি রেখে চাষাবাদ করতে হয়। তার কারণ, প্রাকৃতিক বনজঙ্গল সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দিতে হয়, যাতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
এ কারণে একে স্থানান্তর চাষাবাদ পদ্ধতিও বলেন কৃষিবিদরা। চাষিদের ভাষ্য, দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ায় এবং চাষযোগ্য জমি কমে আসায় আগের মতো জুমচাষ হয় না। মাটির উর্বরতা কমে আসায় বছরের খোরাকি ধানও পাওয়া যায় না। কিন্তু দুর্গম এলাকায় বিকল্প চাষাবাদ পদ্ধতি না থাকায় এখনও জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন তারা।
জুমচাষে কয়েক প্রজাতির ধান হয়ে থাকে। সেগুলো হলো: পিডি, মংথং, কাংবুই, চিবনিংসে ও সূর্যমনি। তার মধ্যে কালো, লাল ও সাদা বিন্নি ধান হয়ে থাকে—যেগুলো দিয়ে তৈরি হয় মজাদার সব পিঠা।
জুমখেতে কেবল ধান নয়, বিভিন্ন ধরনের সাথী ফসলও করা হয়—বিশেষ করে ভূট্টা, মারফা, মিষ্টি কুমড়া, সিনাল, তির, মরিচ, আদা, হলুদ ও তুলা। জুমের মৌসুমে এসব বিক্রি করে বাজার খরচ ওঠে অনেক জুমিয়া পরিবারে।
প্রতিবছর জুম ধান কেটে দেয় একদল শিক্ষার্থী
এদিকে বান্দরবানে প্রতিবছর স্বেচ্ছাশ্রমে জুম ধান কেটে দেয় একদল শিক্ষার্থী। এই জুম ধান কেটে দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয় একদম অস্বচ্ছল ও কম আয়ের জুমিয়া পরিবারকে। ধান পাকার পর একদিন উপযুক্ত সময়ে ওই পরিবারের জুমখেতে গিয়ে ধান কেটে দেওয়া হয়। এতে জুমিয়া পরিবারে খরচ কমে এবং দ্রুত ধান কাটা হয়ে যায়।
ধান কেটে দেওয়া এই শিক্ষার্থীরা জেলা শহরে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে করা হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেন। তাদের একেকজনের বাড়িও দুর্গম এলাকায়। কারও কারও বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। হোস্টেল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে ধান কাটার জন্য এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় কোনো অসচ্ছল জুমিয়া পরিবারের জুমখেতে।
সম্প্রতি বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি এলাকায় দুই জুমচাষির দুটি জুমখেতের ধান কেটে দিয়েছেন এই শিক্ষার্থীরা।
হ্লায়ইসিং মারমা নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, 'একজন অস্বচ্ছল জুমখেতের মালিককে স্বেচ্ছাশ্রমে ধান কেটে দিতে পেরে ভালো লাগছে।'
অপর এক শিক্ষার্থী হ্লামেউ মারমা বলেন, 'সহযোগিতা হিসেবে একজনের জুমের ধান কেটে দিতে পেরে বেশ আনন্দ লাগছে। সময় থাকলে সবাই মিলে ধানও মাড়াই করে দিতাম।'
দুই জুমের মালিক উথোয়াইনু মারমা ও প্রুমেচিং মারমা বলেন, 'প্রথমে আমাদের জুমের ধান কেটে দেওয়া হবে শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে দেখলাম সত্যি সত্যি শিক্ষার্থীর দল নিয়ে জুমখেতে ধান কাটতে এসেছে। আমাদের সাত-আট দিন লাগত কাটতে। এখন একদিনেই কাটা শেষ। তারা এভাবে কেটে না দিলে বিপদে পড়তাম আমরা। হঠাৎ বেশি বৃষ্টি চলে আসলে ধানগুলো ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যেত।'
শিক্ষার্থীদের নিয়ে জুমধান কেটে দেওয়ার উদ্যোক্তা ও স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা 'হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন'-এর নির্বাহী পরিচালক মংমংসি মারমা টিবিএসকে বলেন, 'কয়েকটি কারণে অসচ্ছল বা কম সদস্যের জুমচাষি পরিবার বাছাই করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে জুমধান কেটে দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটি শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুভব করানো। জুমচাষ যেহেতু পাহাড়িদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটার সঙ্গে পরিচিত করানো। তাছাড়া মানুষের সামাজিক ও মানবিক দায়বোধ যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে যায়।'
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দিন দিন পাহাড়ের জুমের আবাদ কমে আসছে। ২০২১ সালে আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জায়গায় এবং উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৭দশমিক ২২ টন চাল। ২০২৩ সালে জুম চাষের আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জায়গায় এবং উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৯ টন চাল। চলতি বছর জুম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জায়গায়, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ টন চাল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. হাসান আলী জানান, বান্দরবানে চলতি বছর প্রায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জায়গায় জুমের আবাদ হয়েছে। এ বছর ফলন ভালো হবে আশা করা যায়। তবে পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে সব জায়গায় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না, যার কারণে উৎপাদনে তারতম্য হয়।
জুমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগ বিভিন্ন পরামর্শ এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে হাইব্রিড-জাতীয় ধান উৎপাদন করার জন্য উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে থাকে বলে জানান তিনি।