জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা
ডিজেল ও কেরোসিনের ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী শুরু হওয়া পরিবহন ধর্মঘট দ্রুত সমাধানের কোনো লক্ষণ না দেখে শঙ্কিত ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা। সরবরাহ চক্রে ব্যাঘাত ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দ্বিমুখী চাপে তারা মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন, যা ইতোমধ্যেই চাপে থাকা সার্বিক অর্থনীতির নাভিশ্বাসের কারণ হবে।
মহামারি পরবর্তী পুনরুদ্ধারের ওপর এই চোট তখনই এল যখন বেড়েছে ভোক্তাদের খরচ, অর্থনীতির প্রায় সকল খাতই উৎপাদন ও বিক্রির দিক দিয়ে মহামারি পূর্ব সময়ে ফিরছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে সরকারের ২০ শতাংশ রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধিও পুনরুদ্ধার আশাব্যঞ্জক একটি পথে এগোনোর ইঙ্গিত দেয়।
পোশাক পণ্য জাহাজীকরণের অবদানে গত কয়েক মাসে রপ্তানিও রেকর্ড প্রবৃদ্ধি নিয়ে শক্তিশালীভাবে ফিরেছে।
তবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শুক্রবার (৫ নভেম্বর) থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘট এখনই ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলছেন, জ্বালানি তেলের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি মহামারির লোকসান থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
সরকার চাইলে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানির দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। অন্তত ছয় মাস মূল্য স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতিও এ সময়ে মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারতো বলে মনে করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের অস্থিতিশীল মূল্য পরিস্থিতির কারণ উল্লেখ করে গত বুধবার লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে সরকার। যার প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেন। তারা পরিবহন ভাড়া বাড়ানো বা মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি করেছেন।
অন্যদিকে, পণ্য বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, শাকসবজি, মুরগির ডিম, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও ডালের দাম শুক্রবার পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলেও শনিবার থেকেই নিত্যপণ্যের দামে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়া শুরু করবে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফাতেমা রাইস এজেন্সির সত্ত্বাধিকারী মাহফুজ আলম বলেন, 'গত ১০ দিনে চালের দাম বাড়েনি। তবে জ্বালানির দাম বাড়ায় আগামী দিনগুলোয় আমরা চালের দামও বাড়ার আশঙ্কা করছি।'
রপ্তানিকারকদের দুর্ভোগ:
রপ্তানিকারকরা জানাচ্ছেন, হঠাৎ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আমদানি-রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে মন্তব্য করেন, 'কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই আমরা চাপের মধ্যে আছি। এ বাস্তবতায়, আকস্মিকভাবে করা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আমাদের গভীর সমস্যায় ফেলবে।'
গেল অক্টোবর মাসেই সুতার দাম বছরওয়ারি হিসাবে ৯২ শতাংশ বেড়েছে। এখন সব খরচ আরও বাড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; লিটারপ্রতি জ্বালানির দাম পাঁচ টাকা বাড়লেই ৪০ টাকা বাড়ে পরিবহন ভাড়া। আবার, কারখানার অনেক মেশিনও চলে ডিজেলে। বর্তমানে একটি মাঝারি আকারের পোশাক কারখানার মাসিক জ্বালানি খরচ আড়াই লাখ টাকা।
এপ্রসঙ্গে নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন- বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর পতন হয়েছিল, তখন সরকার দেশে দাম কমায়নি। তাই এখন বিশ্ববাজারের কথা বলে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
একদিনের ধর্মঘটেই অন্তত সাড়ে ১৩ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানি কার্যক্রম আটকে গেছে। এরপর যদি চলমান পরিবহন ধর্মঘট আরও স্থায়ী হয়, তাহলে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে চালান পাঠানোর চাপ দেবে। ভাড়া করা বিমানে এভাবে চালান পাঠানোর খরচ একটি রপ্তানি পণ্যমূল্যের ৫৫ শতাংশ। আর তা না করতে পারলে, অর্ডার স্থাগিত বা বাতিলের ঝুঁকি রয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম, মোংলা ও বেনাপোলসহ সমুদ্র ও স্থলবন্দরে আমদানিকৃত পণ্য সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক জানান, ধর্মঘটরত শ্রমিকদের বাধার কারণে বন্দরে মাল ডেলিভারি নিতে আসা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মতো যানবাহন প্রবেশ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, 'ধর্মঘট চলতে থাকলে বন্দরের জেটিতে কন্টেইনার লোডিং-আন লোডিং কার্যক্রমও গতি হারাবে।'
কৃষকের জন্য বড় আঘাত:
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে দেশব্যাপী ধর্মঘটের কারণে দেশের কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে দেশের জিডিপিতে ১৪ শতাংশ অবদান রাখা কৃষকদের জন্য শস্য উৎপাদন ও তা পরিবহনের খরচ দুইই বাড়বে। মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক প্রান্তিক কৃষক এতে সর্বশান্ত হয়ে পড়বেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলছেন, সরকারি প্রণোদনা সহায়তায় ধীরে ধীরে মহামারির ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে থাকা কৃষিখাতে হঠাৎ ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম আঘাত নেমে আসবে।
দেশে মোট ডিজেল ও কেরোসিন ব্যবহারের ৬৫ শতাংশ হয় কৃষিতে। জ্বালানির সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ ও ব্যক্তিগত ব্যয় দুইই বাড়াবে। ফলে কৃষকরা চাষাবাদ কমাতে বাধ্য হবে বলে যোগ করেন তিনি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সরকারি প্রণোদনার সুফলকে বাতিল করবে।
অধিক জ্বালানি খরচ বাড়াবে নিত্যপণ্যের মূল্য, যা সীমিত আয়ের মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলবে। এই দরবৃদ্ধি শুধু মূল্যস্ফীতির আগুনে রসদ জোগাবে তাই-ই নয়; একইসাথে ভোক্তাদের খরচ প্রবণতাতেও পরিবর্তন আনবে বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ।
তিনি উল্লেখ করেন যে, পণ্য উৎপাদন খাতে এখন খরচ বাড়তে দেখা যাবে। কিন্তু, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ বাড়তি খরচ ততোটা করতে চাইবেন না।
মহামারি সৃষ্ট সংকটকালে মানুষ যেভাবে সঞ্চয় কমিয়ে বা তা ভাঙিয়ে চলেছেন, আবারো তার পুনরাবৃত্তি হওয়ারও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ড. সেলিম।
গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশেও খাদ্য এবং অ-খাদ্য পণ্যমূল্য চড়ে, ফলে এসময়ে মূল্যস্ফীতিতেও ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
যান চলাচল ঘিরে অনিশ্চয়তা:
শিগগিরই সারাদেশে চলমান পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই, ফলে জনদুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব বলেছেন, "যাত্রী ও পণ্য পরিবাহী যানবাহন মালিক সমিতি ধর্মঘট আহবান করেছে। আগামী রোববার আমরা সরকারের সঙ্গে ভাড়া পুনঃনির্ধারণের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত ( প্রত্যাহার বা অব্যাহত রাখার) জানাব।"
সড়ক পরিবহন বন্ধ থাকলেও নৌপথে যাত্রী পরিবহন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। ৮ নভেম্বরের আগে কোনো কঠোর কর্মসূচি নেওয়া হবে না বলেও জানান তারা। তবে আপাতত যাত্রীপ্রতি ২০ টাকা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে লঞ্চ মালিকদের এক বৈঠক শেষে এসব কথা জানান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউপিসিএ) সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল।
তিনি বলেন, "৮ নভেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে বৈঠকে ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হবে।"
তারা বিআইডব্লিউটিএর কাছে ১০০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
ধর্মঘটের কারণে আজ রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন প্রান্তের যাত্রীরাও চরম দুর্ভোগে পড়েন। বেশিরভাগ সড়কেই ছিল না কোনো গণপরিবহনের উপস্থিতি।
সড়কে বাস না থাকায় বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর আওতাধীন কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে পৌঁছাতে চরম ভোগান্তির শিকার হন।
রাজধানীর সড়কগুলোয় কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিআরটিএ এবং বেসরকারি দুই-তিনটি কোম্পানির বাস চলাচল করেছে। তবে প্রাইভেট কার, রিক্সা, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা এবং মোটরসাইকেল চলাচল স্বাভাবিকই ছিল।