জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারকে প্রভাবিত করবে ভারতের কোভিড দুর্যোগ
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের তৃতীয় বৃহৎ ভোক্তাবাজার ভারত। গেল বছরের শেষ দিক থেকে সিংহভাগ দেশে অর্থনৈতিক পুনঃউন্মুক্তকরণ শুরু হওয়ায় আশা করা হচ্ছিল তেলের বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধিতে ভারত অন্যতম চালিকাশক্তির ভূমিকা রাখবে। কিন্তু, সে আশার গুড়ে বালি দিয়েই বাধ সেধেছে মারাত্মঙ্ক আকার ধারণ করা কোভিড মহামারি। বিকাশের প্রয়োজনে তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দূরে থাক, স্থানীয় অর্থনীতি আবার কবে গতি ফিরে পাবে তা নিয়েও জাগছে অনিশ্চয়তা। ফলে জ্বালানি তেলের বাজারের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানসহ বৃহৎ উৎপাদক প্রায় সকলেরই উদ্বেগে রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড়।
'মহামারির সমাপ্তি টানার লড়াইয়ে ভারত প্রায় শেষ পর্যায়ে' ইতোপূর্বে এমন ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশসহ কুম্ভ মেলার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লাখ লাখ মানুষকে সমবেত হওয়ার প্রণোদনা দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। জানা গেছে, মহামারির মধ্যেই এবার কুম্ভ মেলায় ৩৫ লাখ পূণ্যার্থী অংশ নেন। মার্চের শেষ দিকে যখন সংক্রমণ সংখ্যা বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল তারপরও ধর্মীয় আচার পালনের অনুমতি দিয়ে 'জনপ্রিয়তা ও সংখ্যালগুরু তোষণের' রাজনীতি করেছে বিজেপি এমন অভিযোগ করেছে বিরোধী দলগুলো।
এব্যাপারে ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক ডেভিড ফ্লিকলিং বলেছেন, ভারতের বর্তমান যে দশা তাতে গেল বছরের তুলনায় চলতি ২০২১ সালে অনেক অনেকগুণ বেশি প্রানহানি ঘটবে। আর সরকারি হিসেবের বাইরেই থাকবে মহামারিতে মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা।
মর্মান্তিক রেকর্ড:
খামখেয়ালি স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি মহামারির কেমন অবনতি ঘটায়, তার উদাহরণ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়েও সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি গেল বছর হয় মার্কিনীদের ভূখণ্ডে। মহামারির এই রুঢ় বাস্তবতাই নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত করে। কিন্তু, ভারতীয় রাজনীতিকরা খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের কূটচালে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তুলেছেন। এর মধ্যেই সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সময়ে যতো মৃত্যু হচ্ছিল, তার চাইতে বেশি প্রাণহানি হচ্ছে। প্রতিদিন এই সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে নিত্যনতুন রেকর্ড।
আর যেভাবে বিপুল পরিমাণে সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তা আসলে রূপ নিয়েছে মানবিক ট্র্যাজেডিতে। এই অবস্থা বৈশ্বিক জালানি তেল বাজারের জন্যেও গুরুতর পরিণতি ডেকে আনবে।
অথচ, মহামারির প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে রাখার দৃশ্যমান সফলতার কারণে চীনের পাশাপাশি ভারতকেও জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচির জোরগতির কারণে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমসহ, পর্যটন ও প্রমোদমূলক ব্যবসা চালুর ইঙ্গিত মিলছিল। তাই চলতি বছর ভারতের জ্বালানি তেল চাহিদা অনুমান করা হয় মহামারি পূর্ব সময়ের বেশি বা তার কাছাকাছি পর্যায়ের। বলাই বাহুল্য এখন এসব পূর্বাভাস সংশোধন করে নিম্নগামী করার সময় এসেছে।
পুনরুদ্ধারের পথ:
২০২১ সালের শেষ নাগাদ মহামারি পূর্ব দশায় ভারতের তেল চাহিদা ফিরে আসার আভাস দিয়েছিল আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)।
ব্লুমবার্গের দেবজিত চক্রবর্তী এবং সকেত সুন্দরিয়া তাদের এক প্রতিবেদনে জানান, গেল মার্চের তুলনায় চলতি এপ্রিলে ভারতে ডিজেল ও গ্যাসোলিনের ব্যবহার ন্যূনতম ২০ শতাংশ কমার অনুমান করা হচ্ছে। মুম্বাই ও নয়াদিল্লির মতো বড় শহরগুলো স্থানীয় লকডাউনে প্রাণচঞ্চলতা হারানোই যার প্রধান কারণ।
ঘরে থাকার নির্দেশনা এবার মোটরযানের জ্বালানি চাহিদায় আঘাত হানবে, গণপরিবহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় এতদিন প্রাইভেট কার ও মোটর বাইক চলাচলের উপরই নির্ভরশীল ছিল এ চাহিদা। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে ক্ষতির শিকার ভারতের বাস ও ট্রাক মালিকেরা, ইতোপূর্বে তাদের ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানায় অল ইন্ডিয়া মোটর ট্রান্সপোর্ট কংগ্রেস।
চাহিদা কমার কারণেই শোধনাগার বা রিফাইনারি থেকে সরবরাহ কমবে, ফলে অপরিশোধিত তেলের মজুত বিশাল আকার ধারণ করবে । আগামী দিনে মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নতুন চালান ক্রয় নিরুৎসাহিত করবে বিদ্যমান মজুত। সংক্রমণের ব্যাপকতা এবং তা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান থাকলে ভারতের শোধনাগারগুলোর তেল ক্রয়ে নিশ্চিতভাবেই ধস নামবে। তখন দীর্ঘমেয়াদি তেল বাজারে দেখা দেবে চাহিদার বিশাল শূন্যতা।
কিন্তু, প্রয়োজনের তুলনায় জ্বালানির আধিক্য শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাব নয়, ইতোমধ্যেই ভারত থেকে ফ্লাইট চলাচল নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অনেক দেশ। এই নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক জেট ফুয়েলের বাজার চাহিদাও সঙ্কোচনে পড়তে চলেছে।
সবকিছু দেখেশুনে আতঙ্কে দিশেহারা বৃহৎ জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো। সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং রাশিয়ার মতো ওপেক প্লাস জোটের সদস্য দেশগুলো চাহিদা বৃদ্ধির ফলে অপরিশোধিত জ্বালানির মূল্যস্ফীতি আশা করছিল। কিন্তু, তাদের সেই আশাকে আরেকবার ত্যাগ করার সময় এসেছে। বরং দরের সাঙ্ঘাতিক পতন নিয়ন্ত্রণে রেকর্ড সরবরাহ কর্তনের পন্থাকেই আরও অনেকদিন ধরে রাখতে হবে।
সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি সপ্তাহেই এক মাসিক বৈঠকে মিলিত হবেন ওপেক প্লাস জোটের মন্ত্রীরা। চলতি মাসের শুরুতে তারা আরেকটি বৈঠক করেন, যেখানে তারা মে, জুন ও জুলাই মাসে সরবরাহ কর্তনের নীতি কিছুটা শিথিল করার সময়সূচি নিয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করেন। পূর্ব সেই সিদ্ধান্ত তারা চলতি মাসের বৈঠকে সংশোধন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মে-জুলাই মেয়াদে ওপেক বৈশ্বিক সরবরাহে ২১ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল যুক্ত করতে চেয়েছিল। চলতি সপ্তাহের বৈঠকটি তাই শুধু একটি কারিগরি বৈঠক হিসেবে ধরা হয়, যা সদস্য দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি তদারকি করবে। কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি দূরে থাক তার চেয়েও গুরুতর সমস্যা নিয়ে হবে চলতি সপ্তাহের আলোচনা।
ব্যাপক সরবরাহ কর্তন:
সরবরাহ কর্তন শিথিল করার মেয়াদ পেছাবে ওপেক প্লাস জোট, তাছাড়া সৌদি আরব একক সিদ্ধান্তে আরও বড় আকারের উৎপাদন হ্রাসের ঘোষণা দেবে।
সূত্র: ওপেকের প্রদত্ত তথ্যানুরে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণী আভাস
জ্বালানির দরপতনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই। পারস্য উপসাগর হয়ে জ্বালানি ভর্তি জাহাজ ভারতে যেতে পাঁচ-ছয়দিন লাগে। সে তুলনায় মেক্সিকো উপসাগর পাড়ি দিয়ে আসতে ট্যাঙ্কার জাহাজের সময় লাগে পাঁচ- ছয় সপ্তাহ। অর্থাৎ, সরবরাহের প্রধান ও সহজ উৎস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদকদের কাছ থেকে ভারত তেল কেনা বন্ধের ঘোষণা দিলেও ইতোমধ্যেই যাত্রাপথে থাকা চালান পৌঁছাতে বেশ সময় লাগবে, যা আগামী জুনের আগে নাগাদ মার্কিন উৎপাদকদের প্রভাবিত করবে না। কিন্তু, এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে চলতি এপ্রিলের শেষেই তার প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে।
মূল্য নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ইতোমধ্যেই সৌদি আরব ছেড়ে জ্বালানি তেলের বিকল্প উৎস খুঁজছে ভারত। চাহিদার ধস সেই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
জানুয়ারিতে পরিকল্পিত সরবরাহ কর্তন শিথিল করাকে পেছানোর পর জুলাই নাগাদ বৈশ্বিক চাহিদার কারণে তা করা সহজ হবে বলে ধারণা করেছিল ওপেক প্লাস। ভারতের জ্বালানির বাজারে ধস সহসাই তেমন পদক্ষেপ নেওয়াকে করে তুলবে আরও দুঃসাধ্য। ফলে ওপেক প্লাস মন্ত্রীরা সরবরাহ উৎস আরও সঙ্কোচন করতে অথবা তা না করে জ্বালানি তেলের ব্যাপক দরপতন ঘটতে দেওয়ার মতো যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন। যদিও শেষোক্ত পরিণতি কেউই চান না।
- লেখক: জুলিয়ান লী ব্লুমবার্গ ফার্স্ট ওয়ার্ডের জ্বালানি তেল কৌশলবিদ। ইতোপূর্বে, তিনি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গ্লোবাল এনার্জি স্টাডিজে জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ