দর পতনের আতঙ্কে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা
দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস পর পেঁয়াজ রপ্তানি উন্মুক্ত করেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এতে পণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে। গত চারদিনে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কমেছে ৫-২০ টাকা। দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন মৌসুমে ভারত রপ্তানি উন্মুক্ত করায় দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী কৃষকরা বড় লোকসানে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া গেল তিন মাসে যেসব আমদানিকারক দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মিটিয়েছে, তাদেরও বড় লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বিকল্প দেশ থেকে আমদানি হওয়া ২৪ হাজার টন পেঁয়াজ এখনো চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায়। যার আমদানি মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এছাড়া উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র নিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হঠাৎ করে কম দামে ভারতীয় পেঁয়াজ দেশে এলে সংকটকালে বিকল্প দেশ থেকে যারা পেঁয়াজ আমদানি করে দেশের চাহিদা মিটিয়েছেন, তারা এবং স্থানীয় কৃষকরা উৎসাহ হারাবেন। যেহেতু সংকটকালে প্রতি বছর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাই দেশীয় মৌসুমে ভারতীয় পেঁয়াজ কীভাবে কতটুকু আমদানি করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা প্রয়োজন।
এর আগে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গত ১৪ সেপ্টম্বর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। সেই থেকে গেল সাড়ে তিন মাস দেশের চাহিদা পূরণ করতে ১০-১২টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে দেশের ব্যবসায়ীরা।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রামের তথ্যমতে, ভারতের রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর থেকে ১১টি দেশ থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১১ হাজার ৭৫৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। যা দিয়ে সংকটকালে দেশের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। বিকল্প দেশগুলো হলো চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মিশর, আরব আমিরাত, তুর্কি, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন ও মালয়েশিয়া। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ এসেছে পাকিস্তান থেকে ২২ হাজার মেট্রিক টন ও মিশর থেকে ১৯ হাজার মেট্রিক টন।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণার পর থেকে ব্যবসায়ীরা বিকল্প দেশ থেকে সমুদ্র পথে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১১ হাজার ৭৫৮ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানির ছাড়পত্র দিয়েছে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা পণ্য (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) ব্যবসায়ীরা জানান, কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সংকটের কথা বলে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। ওই সময়ের পর থেকে দেশের আমদানিকারকরা ১০-১২টি বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। সংকট কাটাতে পেঁয়াজ আমদানি করতে গিয়ে এই সময়ে বহু ব্যবসায়ীকে বড় লোকসান গুনতে হয়েছে।
লোকসান হওয়ার কারণ হিসেবে খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ আমদানিকারক নুরুল আলম মাস্টার বলেন, 'ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর অক্টোবরে চীন থেকে ১৪৫ টন পেঁয়াজ আমদানি করি। সেসব পেঁয়াজ আমদানিতে গড়ে প্রতি কেজি খরচ পড়েছে ৪২ টাকা। কিন্তু আমদানিকৃত পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়া ও একই সময়ে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সেই পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়েছে প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে। এর ফলে ওই এক চালানেই লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।'
গত কয়েক বছর ধরে ফল আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রমিজ উদ্দিন। ভারতের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ঘোষণায় পাকিস্তান থেকে প্রায় ২০০ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তান থেকে গড়ে ৪৫ টাকায় কেনা পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জে বিক্রি করতে হয়েছে প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে। এতে প্রায় কোটি লোকসান দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে নতুন এই উদ্যোক্তাকে।
খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মার্কেট কাঁচাপণ্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইদ্রিচ বলেন, 'ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় গত সাড়ে তিন মাসে বাজারে পেঁয়াজের অনেক উত্তান-পতন হয়েছে। এরমধ্যে কাঁচাপণ্যের নিয়মিত ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু মৌসুমী ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানি করেছে। এতে কেউ কেউ লাভের মুখ দেখলেও বেশিরভাগ আমদানিকারককে বড় অংকের লোকসানা গুনতে হয়েছে। এই মুহূর্তে বিকল্প প্রায় প্রতিটি দেশের পেঁয়াজ বাজারে আছে। এই সময়ে কম খরচে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ায় আরও বড় অংকের লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা ব্যবসায়ীদের।'
খাতুনগঞ্জের কাঁচা পণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী বলয় কুমার পোদ্দার বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে ভারত নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই দেশীয় পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হয়, তখন তারা পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এমনকি রপ্তানি মূল্যও কমিয়ে দেয়। এতে প্রতি বছর পেঁয়াজ উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হয়ে দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদনকারী কৃষকদের। ফলে বছর বছর পেঁয়াজ উৎপাদন না বেড়ে বরং দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদন কমছে। এতে দেশীয় পেঁয়াজের মৌসুম শেষে সংকট বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা করেন ভারতীয় রপ্তনিকারকরা।'
এদিকে, চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'প্রায় প্রতি বছর দেশি মৌসুমের সময় পেঁয়াজের বাজার সর্বনিম্নে চলে আসে। এবারও দেশীয় পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হতে না হতেই এতদিন বন্ধ থাকা পেঁয়াজ রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এতে গত দুই-তিন দিনেই দেশীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে প্রায় ১০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। এভাবে প্রতি বছর দেশের কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'নায্য দাম না পেয়ে কৃষকরা পরবর্তীকালে পণ্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।'
'মৌসুমের সময় পেঁয়াজের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে কৃষকরা পণ্যটির নায্য দাম পাবেন। এতে বছর বছর পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়বে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তর ও টিসিবির তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২২-২৩ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ২০১৮ সালের হিসেবে দেশে ১৭-১৮ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন। গেল অর্থবছরে এই উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ লাখ টন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে সংগ্রহত্তোর অপচয় হিসেবে ২৫ শতাংশ অপচয় বাদ দিলে ব্যবহার উপযোগী পেঁয়াজ থাকে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন।
এদিকে আবাদকৃত পেঁয়াজের প্রায় ২ শতাংশ পরবর্তী বছরের বীজের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সেই হিসেবে, প্রায় প্রতি বছর ৯-১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজেও সরবরাহ ও বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ অপচয় হয়।
বিগত সময়গুলোতে আমদানিকৃত এসব পেঁয়াজের বেশিরভাগই আমদানি করা হতো ভারত থেকে। তবে গেল দুই বছর ধরে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে দেশের আমদানিকারকরা।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের আড়ত ও পাইাকারি দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ মানভেদে ২০-৫০ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হচ্ছে। যা গত সপ্তাহের শুরুতে ২৫-৬৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো। সেই হিসেবে গত চারদিনে মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কমেছে ৫-২০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
বর্তমানে বাজারে ভারত থেকে আমদানিকৃত ইন্দুরি জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৭-৫০ টাকা, তুর্কি থেকে আমদানি করা গোল জাতের পেঁয়াজ ৪৫-৪৬ টাকা ও একই দেশের লম্বা জাতের পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত সপ্তাহের শেষ দিন পর্যন্ত বাজারে তুর্কির গোল পেঁয়াজ ৬৫ টাকা ও লম্বা পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহে বাজারে ইরানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০-৪২ টাকা। যা গত চারদিনে কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমানে নিউজিল্যান্ড থেকে আমদানি করা সাদা জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০-২২ টাকায়। একই দেশের লাল জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। গত সপ্তাহে নিউজিল্যান্ডের সাদা পেঁয়াজ সর্বনিম্ন ২৫ টাকা ও লাল পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। গেল সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৫ টাকার মধ্যে। কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪৫ টাকার নিচে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে গত দুই সপ্তাহ থেকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন মৌসুমের দেশীয় পেঁয়াজ, যা বর্তমানে ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকার মধ্যে।