ধামাকার কারসাজি: বিলাসপণ্যে অবাস্তব ছাড়
ধামাকাশপিংয়ের সর্বশেষ ক্যাম্পেইন ছিল মার্সিডিজ বেঞ্জ নিয়ে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি এই বিলাসবহুল গাড়িতে ৩০% ছাড় দেয়।
বিলাসপণ্যে বিশাল ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে তাদেরকে ঠকানোর অভিযোগ উঠেছে ধামাকাশপিংয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, অনলাইন শপটি খুব কমই অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের টাকা রিফান্ড দেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নতুন এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রথমে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে। তারপর ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনলাইন ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে।
এ বছরের এপ্রিলে ধামাকা সিঙ্গার ব্র্যান্ডের ডাবল-ডোর রেফ্রিজারেটর ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রির অফার দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ সংগ্রহ করে। ফ্রিজটির প্রকৃত দাম ৮৫ হাজার টাকা।
কিন্তু অনলাইন শপটি জুন পর্যন্ত তিন মাসে একটি পণ্যও কোনো গ্রাহককে সরবরাহ করেনি।
এই প্রতিবেদকও গত ৯ মে একটি ফ্রিজ অর্ডার করার পর তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ২৩ জুন পণ্যটির জন্য ধামাকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার সিরাজুল ইসলাম রানা জানান, তারা এখনও পণ্য সরবরাহ শুরু করতে পারেনি।
রানা আরও জানান, পণ্য পাঠাতে দেরি হবে। কবে পাঠানো হবে, তাও অনিশ্চিত। রানা টাকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু রিফান্ডও দেওয়া হয় বেশ বিলম্বে। অবশেষে ১৬ জুলাই এই প্রতিবেদক ধামাকাকে সেদিনের মধ্যে টাকা ফেরত না দিলে মামলা করবেন বলে হুমকি দেন। এ হুমকির পর মোবাইল আর্থিক পরিষেবা বিকাশের মাধ্যমে তার টাকা ফেরত দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে আগের ক্যাম্পেইনের পণ্য সরবরাহ না করেই ধামাকা আরেকটি ক্যাম্পেইন শুরু করে। এবারের ক্যাম্পেইনে অনলাইন শপটি ৩০ শতাংশ ছাড়ে মার্সিডিজ বেঞ্জ বিক্রি করে। এবার ৬০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য অনলাইন শপটি কিছু শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে এই ক্যাম্পেইনের প্রচারণা চালায়।
অত্যন্ত দামি এই গাড়ি কম দামে বিক্রির অফার দিলেও মার্সিডিজ বেঞ্জের সরবরাহকারীর সঙ্গে ধামাকার কোনো চুক্তি হয়নি।
বাংলাদেশে মার্সিডিজ বেঞ্জের একমাত্র অফিসিয়াল ডিলার র্যাংগস মোটরস। ধামাকার সঙ্গে মার্সিডিজ বেঞ্জের কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে বলে তাদের জানা নেই।
র্যাংগস মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মার্সিডিজ বেঞ্জ সরবরাহ নিয়ে ধামাকার সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি নেই।
তিনি অবশ্য বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মার্সিডিজ বেঞ্জের একমাত্র অফিসিয়াল ডিলার হলেও, 'গ্রে মার্কেটে'ও কিছু আমদানিকারক রয়েছে।
বিজ্ঞাপনে ধামাকা কোনো সরবরাহকারীর নামও উল্লেখ করেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে এরকম লোভনীয় অফারের মাধ্যমে ধামাকাশপিং ৩৫০ কোটি টাকার বেশি অর্ডার জোগাড় করেছে।
এখন হাজার হাজার গ্রাহক তাদের অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য অনলাইন শপটির পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) এই অনলাইন শপের বিরুদ্ধে অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে। ডিএনসিআরপির তথ্যানুসারে, ধামাকাশপিংয়ের দাবি নিষ্পত্তির হার ২০ শতাংশেরও কম।
এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক তদন্তে সন্দেহ প্রকাশ হয়েছে যে ধামাকা দেশ থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে।
তদন্তকারীদের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম পণ্যের অগ্রিম মূল্য হিসেবে এই টাকা সংগ্রহ করেছে ধামাকা। তারপর এ টাকা অন্য লোকের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছে।
সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, 'ডাবল টাকা ভাউচার', 'সিগনেচার কার্ড'সহ অন্যান্য অস্বাভাবিক মোটা ছাড়ের লোভনীয় অফার দিয়ে হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে ধামাকা।
সূত্রটি আরও জানায়, এরকম জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
ধামাকাশপিং যাত্রা শুরু করে গত বছরের নভেম্বরে। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি আরেক বিতর্কিত অনলাইন শপ ইভ্যালির মতো বাইকসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর ৪০%-৫০% পর্যন্ত বিশাল ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রচুর অগ্রিম টাকা সংগ্রহ করেছে।