নতুন ও বিদেশি ব্যাংকেও মন্দ ঋণের সংক্রমণ
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে এবং ব্যাংকিং খাতের নতুন দ্বার উন্মোচনে লক্ষ্যে ২০১৩ সালে নয়টি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকের অনুমোদন দেয় সরকার। তবে পুরনো ব্যাংকগুলোর মতো মন্দ ঋণের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে এসব ব্যাংকেও।
বিগত বছরগুলোতে একই চিত্র দেখা গেছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতেও। এক সময় এই ব্যাংকগুলো সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু গত ৫ বছরে এই ব্যাংকগুলোতেও মন্দ ঋণের গ্রাসে পড়ে, তবে এর পরিমাণ সরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক কম।
২০১৬- ২০২০ সালের ৫৯টি ব্যাংকের খেলাপি ও মন্দ ঋণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরিমাণে কম হলেও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ দ্রুত বাড়ছে এবং ছয়টি বিদেশি ব্যাংকের মন্দ ঋণ মোট খেলাপির প্রায় শতভাগ।
সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)। গত ৫ বছরে ব্যাংকটির মন্দ ঋণ মোট খেলাপি ঋণের শতভাগ ছিল। ইতোমধ্যে ব্যাংকটির সিলেট শাখা বন্ধ হয়ে গেছে, তবে মতিঝিল, গুলশান ও চট্টগ্রাম শাখার কার্যক্রম এখনো চলমান। বাংলাদেশে ব্যাংকটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পথে- আন্তজার্তিক গণমাধ্যম প্রকাশিত এমন খবর অস্বীকার করেছেন এনবিপি'র কান্ট্রি হেড মো. কামরুজ্জামান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানান, সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ করার কোন পরিকল্পনা নেই। মন্দ ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন করে ঋণ দিতে না পারায় মন্দ ঋণের পরিমাণ শ্রেণিকৃত ঋণের শতভাগ দেখাচ্ছে।
ঋণ আদায় প্রসঙ্গে বলেন, আদালতে যাওয়ার চাইতে কিছুটা ছাড় দিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। এর ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এনবিপি প্রসঙ্গে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এটি কোন বহুজাতিক ব্যাংক নয়। আঞ্চলিক এই ব্যাংকটি পাকিস্তানের সরকারি ব্যাংক।
বাংলাদশে যেমন সরকারি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি আছে আশেপাশের দেশগুলোর সরকারি ব্যাংকও এ থেকে ব্যতিক্রম নয়, যোগ করেন তিনি।
বিদেশি ব্যাংকের মন্দ ঋণ প্রসঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যেসব বিদেশি ব্যাংক রিটেইল ও এসএমই ব্যাংকিং এর সাথে যুক্ত তাদের মন্দঋণ একটু বেশি। সুশাসনের প্রশ্নে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানো বহুজাতিক ব্যাংকগুলো অনেক ভালো অবস্থানে আছে বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে মামুন রশিদ বলেন, সাধারণত দেশি ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণ কমিয়ে দেখাতে চায়। বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা থাকে না। এজন্যই মোট খেলাপির হিসেবে মন্দ ঋণের হার বিদেশি ব্যাংকগুলোতে অনেক বেশি দেখাচ্ছে। যদিও এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ব্যাংক খাতের গড় হার থেকে অনেক কম।
সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই এখন মন্দ ঋণ। গেল পাঁচ বছরে মন্দ ঋণের পরিমাণ ২৪,৭৫২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৭ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে, যা মোট খেলাপির প্রায় ৮৭ শতাংশ।
মন্দঋণের যে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তা ২টি পদ্মা সেতু কিংবা ৩টি মেট্রোরেল অথবা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের মত ৪টি বন্দর তৈরির প্রকল্প ব্যয়ের সমান।
মন্দঋণের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সহজে এটি আদায় করা যায় না। আইনী ও অন্যান্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে অনেক ক্ষেত্রে মন্দঋণ আদায় করা ব্যাংকের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোই ঋণ বিতরণে অনিয়ম করছে এবং গতানুগতিক ধারার ব্যাংকিং সেবা দেওয়ায় পুরনো ব্যাংকের মতো এসব ব্যাংকেও মন্দ ঋণ বাড়ছে।
অন্যদিকে সুশাসনের প্রশ্নে বহুজাতিক ব্যাংকগুলো এগিয়ে থাকলেও আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি বাংলাদেশের মত হওয়ায় এসব ব্যাংকেও মন্দঋণের সংক্রমণ বেড়ে গেছে বলে তারা মনে করেন।
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকে মন্দ ঋণ
ফারমার্স থেকে নামে পাল্টে হয়ে যাওয়া পদ্মা ব্যাংকের মন্দঋণ ৫ বছরে ৩২ গুণ বেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট খেলাপির ৯০ শতাংশের বেশি।
ব্যাংকটি পাঁচ বছর ধরেই মন্দ ঋণের তালিকায় উপরের দিকে আছে। মন্দ ঋণ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর সাথে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
চতুর্থ প্রজন্মের অন্য ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণের পরিমাণ পদ্মা ব্যাংকের তুলনায় সামান্য হলেও পাঁচ বছরে এসব ব্যাংকের মন্দঋণ দুই- ২৫০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (এবিবি) এর সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদগুলোর রাজনৈতিক আনুগত্য থাকায় একটি তোষণ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা ঋণ প্রদানে অনিয়ম করছে।
এছাড়া দক্ষ জনবলের ঘাটতি, নতুন পণ্য আনতে না পারা, গতানুগতিক ব্যাংকিং সেবা এবং পুরনোদের কাছ থেকে শিক্ষা না নেওয়ার মানসিকতাই এসব ব্যাংকের মন্দঋণ দ্রুত বাড়ার কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মন্দ ঋণে জর্জরিত সরকারি ব্যাংক
বিগত পাঁচ বছর ধরেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ব ছয়টি বাণিজ্যিক ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২,৪৫০ কোটি টাকা, যা ওই বছরের ব্যাংক খাতের মোট মন্দ ঋণের ৫৫ শতাংশ।
২০১৬ ও ২০১৭ সালে মন্দ ঋণের ভারে সোনালী ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকলেও গেল তিন বছর ধরে জনতা ব্যাংক সেই অবস্থানে চলে গেছে। পাঁচ বছরে জনতা ব্যাংকের মন্দঋণ চার গুণেরও বেশি বেড়ে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালামের সাথে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল ধরেননি। ক্ষুদে বার্তা দিলেও কোন জবাব মেলেনি।
বেসরকারি ব্যাংকের মন্দ ঋণ
পাঁচ বছরে এসব ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ এখন এবি ব্যাংকের। পাঁচ বছরে ব্যাংকটির মন্দঋণ ৭ গুণ বেড়ে এখন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী জানান , তারা ভালো করার চেষ্টা করছেন।
সার্বিক ভাবে ব্যাংকখাতের মন্দঋণ কমানো প্রসঙ্গে রুমি আলী বলেন, এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকদের সাথে বসতে হবে। আইনগত বাধাগুলোও দূর করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে কাউকে দোষারোপ না করে মন্দঋণ আদায়ের একটি উপায় খুঁজে বের করার।
মন্দ ঋণ কমেছে যে সব ব্যাংকের
গেল পাঁচ বছরে মাত্র ১৫টি ব্যাংক তাদের মন্দ ঋণ কমিয়ে আনতে পেরেছে। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংক ১হাজার ৩০০ কোটি টাকা কমালেও গেল বছর শেষে মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ২,৩২০ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আলী হোসেন প্রধানিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, অবলোপন করে মন্দ ঋণ কমায়নি কৃষি ব্যাংক। আদায় তৎপরতা বাড়ানোর ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।
এদিকে পূবালী ব্যাংক ২৩৩ কোটি টাকা, ইউসিবিএল প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা এবং ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৫২৪ কোটি টাকা মন্দ ঋণ কমাতে পেরেছে।
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঋণ আদায় ও মনিটরিং শক্তিশালী করা এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সুযোগ না দেওয়ায় সফলতা পেয়েছেন তারা।
কখন ঋণ মন্দ হয়?
কোনো ঋণের কিস্তি ৩ থেকে ৯ মাস বকেয়া পড়লে তা সাব-স্ট্যান্ডার্ড (নিম্ন-মান), ৯ মাসের বেশি ও ১২ মাস বা তার কম হলে ডাউটফুল (সন্দেহজনক) এবং ১২ মাসের বেশি হলে ব্যাড/ লস (মন্দমান/লোকসানি) ঋণে শ্রেণিকরণ হয়।
এই তিন ধরনের শ্রেণিকরণের বিপরীতে ব্যাংককে যথাক্রমে ২০%, ৫০% ও ১০০% হারে প্রভিশন রাখতে হয়। অনেক ব্যাংক এই প্রভিশন রাখতেও ব্যর্থ হয়। গেল বছর ১১টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল।
খেলাপি কিংবা মন্দ ঋণ বাড়লে প্রভিশনিং বাড়ে, এতে ব্যাংকের আয় কমে যায়। ঋণ ফেরত না আসায় নতুন ঋণ বিতরণও ব্যাহত হয়। অর্থাৎ ব্যাংকের স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে যায়।
প্রভিশনিং বেশি রাখতে হলে মূলধন পর্যাপ্ততা সংরক্ষণেও (সিএএআর) ব্যর্থ হয় ব্যাংকগুলো। গেল বছর ৩টি বেসরকারি ও ৭টি সরকারি ব্যাংক সিএএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে কোম্পানি গঠন
খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করবে সরকার। এই কোম্পানি ব্যাংকের মন্দ ঋণ স্বল্প দামে কিনে নিয়ে তা আদায়ে কাজ করবে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, অনেক দেশ এই উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি। বরং, ব্যাংক খাতে নজরদারি বাড়ানো ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার পক্ষপাতী সংস্থাটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য
মন্দ ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে চেষ্টা করে।
এছাড়া ব্যাংকগুলোর নিজস্ব প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে। যদি কোন ব্যাংক ঋণ দেওয়ার সময় ভালো গ্রাহক নির্বাচন করে, জামানত সঠিক থাকে এবং মনিটরিং করা হয় তাহলে খেলাপি ঋণ বাড়বে না।
এক্ষেত্রে ব্যাংকারদের প্রায়শই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিয়ে থাকে বলে তিনি জানান।