মাত্র তিন সপ্তাহে সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার মন্দ ঋণ যেভাবে আদায় করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ার পর— ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র তিন সপ্তাহে ৩৫০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ আদায় করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি), যা ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্ময়কর এক ঘটনা বলতে হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন মান্নান, এরপরেই তার নেতৃত্বে জোর কদমে শুরু হয় ঋণ আদায় কার্যক্রম। কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ ও ব্যাংকের নির্বাহীদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে তাতে সাফল্য আসে বলে জানান তিনি।
আগে এই ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করতেন এল আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদ। তখন এসব নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) আদায়ে হিমশিম খেত ব্যাংকটি। কিন্তু, মান্নান চেয়ারম্যান হওয়ার পরে দ্রুত আদায়ের ঘটনায়— ভবিষ্যতে এই ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে নতুন আশা দেখা যাচ্ছে।
আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে আরো পদক্ষেপ নেওয়ার আভাস দিয়ে মান্নান টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংকের পুনরুদ্ধার সম্পর্কে আমি খুবই আশাবাদী।"
ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করার নতুন কৌশলের মাধ্যমে – ঋণ খেলাপিদের ওপর চাপ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি।
"দরকার হলে আমাদের নির্বাহীরা খেলাপিদের বাড়ির সামনে অবস্থান নেবেন, ফলে তাদের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই জানতে পারবে– এসব ব্যক্তি তাদের ঋণ পরিশোধ করে না, আবার দেশ-বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন ঠিকই করছে"- বলছিলেন মান্নান এর আগে যিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নতুন এই চেয়ারম্যানের প্রচেষ্টা শুধু মন্দ ঋণ আদায়েই কেন্দ্রীভূত নয়, ব্যাংকটি নতুন আমানত এবং গ্রাহকও আকৃষ্ট করছে।
মান্নান জানান, মাত্র দুই দিনে ২,৭০০ ক্যাশ ওয়াকফ ডিপোজিট হিসাব খোলা হয়েছে – ব্যাংকিং সেবার এই প্রোডাক্ট সম্পর্কে আগে সেভাবে জানতেন না ব্যাংকটির কর্মীরা।
ক্যাশ ওয়াকফ একটি শরীয়াহ-ভিত্তিক আমানত, সামাজিক কল্যাণের জন্য চিরকালীন অনুদানের অর্থ যেখানে রাখা হয়।
ব্যাখ্যা দিয়ে মান্নান বলেন, এসব আমানত থেকে যে মুনাফা আসে– তা দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানসহ নানান রকম দাতব্য কাজের জন্য অর্থের জোগান নিশ্চিত করা যায়।
তবে এফএসআইবির প্রায় ২০ লাখ গ্রাহকের আমানত – যেভাবে মাত্র ২০০ ঋণগ্রহীতার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগই ব্যক্ত করেন ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান।
এসব ঋণের বেশিরভাগই বিতরণ করা হয়েছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ঢাকার গুলশান ও মতিঝিল মাত্র তিনটি শাখা থেকে।
মান্নান বলেন, সারাদেশের ২০৫টি শাখা ও ১৭৫টি উপ-শাখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করা হলেও – এসব বিনিয়োগের অধিকাংশই চলে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছোট একদল গ্রাহকের কাছে। সম্পদ এভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি অবহেলিত হয়েছে, এবং যখন অত্যন্ত দরকার ছিল তখন আর্থিক বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ব্যাংকটির ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের মোট আমানতের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, এরমধ্যে ১৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকাই এসেছে অন্যান্য ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে।
গত বছর শেষে, ব্যাংকের ৬৩ গ্রাহকের কাছে বিনিয়োগ করা হয়েছিল মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি, এই ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। এমনকী সাতজন গ্রাহক ব্যাংকের মোট রেগুলেটরি ইক্যুইটির ১৫ শতাংশের বেশি বা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
ওই প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে, এফএসআইবি প্রায় ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার ঋণ শ্রেণিকরণ করেছে, আর মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয় ১৪ হাজার কোটি টাকা, যার বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণের দরকার।
তবে প্রকৃত পরিমাণ আরো বেশি বলে এর আগে জানিয়েছিলেন ব্যাংকের অভ্যন্তরীণরা। তারা জানান, পুনঃতফসীল ও অন্যান্য আর্থিক হিসাবনিকাশের মাধ্যমে ব্যাংকের মন্দ ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হলে, গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর বাংলাদেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগের মধ্যে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের এমন অনেক তথ্য জানা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর দ্রুতই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমস্যাসঙ্কুল সাত ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়।
এরমধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও ছিল, আগে যার নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদের হাতে। শুধুমাত্র কাগজেকলমেই অস্তিত্ব আছে এমন সব কোম্পানির নামে যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে, তারমধ্যে এস আলম ছিল অন্যতম। সমস্যাসঙ্কুল সাত ব্যাংকের ছয়টিতেই মালিকানা ছিল মাসুদের।
স্বল্পমেয়াদি তারল্য সহায়তা পেলে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আশাবাদী এফএসআইবি
সমস্যাসঙ্কুল ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের থেকে তহবিল নিতে পারবে, যেখানে গ্যারান্টার হিসেবে থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এফএসআইবি'র চেয়ারম্যান মান্নানের মতে, এধরনের সাময়িক তারল্য বা নগদ সহায়তা ব্যাংকটির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর এফএসআইবি-সহ সংকটকবলিত পাঁচ ব্যাংককে আন্তঃবাজার মুদ্রাবাজার থেকে নগদ অর্থ ঋণ নিতে একটি গ্যারান্টি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায়, ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছে এফএসআইবি।
মান্নান বলেন, "আমরা যদি দুই থেকে তিন মাসের জন্য তারল্য পাই, আমার বিশ্বাস তাহলে এফএসআইবি পুনরুদ্ধারে যেতে পারবে এবং এই সময়ের মধ্যেই ঋণগুলো পরিশোধ করে দেবে। ২০২৫ সাল আমরা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে শুরু করতে চাই।"
তবে এই তারল্য সহায়তার বিপরীতে ৯টি শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্ত অনুসারে, এই ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে এক বছর, বিদ্যমান স্পেশাল লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুদ দিতে হবে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে।
সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তারল্য সরবরাহকারী ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের নামে ৯০ দিন মেয়াদের 'তলবি ঋণ' তৈরি করতে পারবে।
ঋণ নেওয়া ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যাংকের স্থায়ী সম্পদ, বন্ড ও অন্যান্য সিকিউরিটিজ বিক্রি করে নগদ অর্থ আদায় করবে। এছাড়া, চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা না হলে এসএলএফের হারের ওপর অতিরিক্ত দুই শতাংশ সুদ বা মুনাফা আরোপ করা হবে।