নতুন মৌসুমে চালের দাম কমলেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে
টানা কয়েক মাস ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর অবশেষে কমতে শুরু করেছে চালের বাজার। বোরো মৌসুমের চালের দাম কমলেও পুরনো চালের বাজার আগের মতোই স্থির রয়েছে। এরই মধ্যে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন আসা চালের বস্তাপ্রতি দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। নতুন মৌসুমের প্রভাবে পাইকারিতে চালের দাম কমলেও প্রভাব নেই খুচরা বাজারে।
তিন সপ্তাহ ধরে দেশের বাজারে নতুন মৌসুমের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এর আগে দেশে চালের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ভারত ও বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি শুরু হয়। যা দেশের ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। তবে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু ও বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে চালের দাম ফের বেড়ে যায়। এ নিয়ে টানা ৫ থেকে ৬ মাস চালের বাজার অস্থির ছিল। কিন্তু সর্বশেষ বোরো মৌসুমের ধান কাটার শেষ পর্যায়ে বাজারে নতুন চাল আসতে শুরু করলে বাজার নিম্নমুখী হতে থাকে। তবে নতুন চালের বাজার কমলেও পুরনো চালের দাম আগের মতোই বাড়তি অবস্থায় স্থির রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নতুন মৌসুমের চালের সরবরাহ শুরু হলে বাজারে দাম কমে যায়। তবে গত এক বছর ধরে দেশে চালের বাজার অস্বাভাবিক পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন মৌসুমের চালেও ভালো লাভ করছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে চালের বুকিং বেড়ে যাওয়ায় এতদিন দেশে চালের দামে প্রভাব পড়েনি। সরকারিভাবে আমদানির সুযোগ বাড়ানো, শুল্ক কমানো ছাড়াও দেশব্যাপী ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি ও সরবরাহ বাড়ানোর ফলে বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে নতুন মৌসুমের চালের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমলেও পুরনো বা আগের মৌসুমের চালের দাম পূর্বের মতোই বাড়তি অবস্থায় স্থিতিশীল রয়েছে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন আসা স্বর্ণা সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২ হাজার ১০০ টাকা দরে। যদিও একই জাতের পুরনো (আগের মৌসুমের চাল) চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ টাকায়। এছাড়া গুটি সিদ্ধ (পুরনো) ২ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হলেও নতুন গুটি সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়, মোটা সিদ্ধ ১ হাজার ৮০০ টাকায় (পুরনো ১ হাজার ৯০০ টাকা), মিনিকেট সিদ্ধ ২ হাজার ৪০০ টাকায় (পুরনো ২ হাজার ৬০০), পারি সিদ্ধ ২ হাজার ৩০০ টাকায় (পুরনো ২ হাজার ৫৫০), জিরাশাইল ২ হাজার ৭৫০ টাকায় (পুরনো ৩ হাজার ৫০ টাকা), নাজিরশাইল ২ হাজার ৮০০ টাকায় (পুরনো ৩ হাজার টাকা) বিক্রি হচ্ছে।
অপরদিকে আতপ চালের মধ্যে নতুন আসা বেতি চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। যদিও একই মানের পুরনো বেতি আতপ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়। অর্থাৎ নতুন আসা বেতি চাল আগের মৌসুমের চেয়ে বস্তাপ্রতি ৪০০ টাকা কম। যা কেজির হিসাবে ৮ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। অপর দিকে মোটা আতপ (ইরি) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকায় (পুরনো মৌসুমের মোটা আতপ ১ হাজার ৯০০ টাকা)। এছাড়া আতপ পাইজাম ২ হাজার ৯০০ (পুরনো ৩ হাজার ২০০ টাকা) টাকায়, কাটারী আতপ ৩ হাজার টাকা (পুরনো ৪ হাজার টাকা) বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স জেএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, বোরো মৌসুমের চালের সরবরাহ আসায় বাজারে দাম কমেছে। তবে নতুন চালের দাম কমলেও পুরনো চালের দাম আগের মতোই স্থির রয়েছে। দেশীয় চালের সরবরাহ বৃদ্ধি ছাড়াও আমদানিকৃত চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে আগামীতে চালের বাজার ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীল হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
সরকার চলতি বোরো মৌসুমে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চালসহ সর্বমোট সাড়ে ১৬ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত ৬ মে খাদ্য মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে আগামী আগস্টের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। এ জন্য ৯ মে এর মধ্যে মিলারদের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে কার্যক্রম শুরু করতে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনায় ৩০ জুনের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশ, জুলাইয়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং আগস্টের মধ্যে অবশিষ্ট ১০ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়।
অ্যাপস'র মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হবে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আবেদন পাওয়া না গেলে 'আগে আসলে আগে পাবেন' ভিত্তিতে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হবে। নির্দেশনা মোতাবেক ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমে গত ১৮ মে পর্যন্ত ২০ হাজার ৬৫১ টন বোরো ধান ও ৬৭ হাজার ৭২৮ টন বোরো চাল সংগ্রহ হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, টানা দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার চাল আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। তবে আমদানি প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল আমদানি হয়নি। এতে শুল্ক কমানোর সুবিধার পরও দেশের চালের বাজার ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের দেশীয় চালের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী শান্ত দাশ গুপ্ত বলেন, লকডাউনের ঘোষণার পর থেকে পাইকারি বাজারে চালের দাম যায়। আমদানি প্রক্রিয়া উন্মুক্ত না করে নির্দিষ্ট করে দেয়ায় চাল আমদানি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গতিবেগ পায়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে অস্বাভাবিক বেড়ে যায় নিত্যপণ্যটির বাজার। তবে বোরো ধানের ফলন আসার সাথে সাথেই বাজার কমতে শুরু করেছে। পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে এখনো এর প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করেছেন তিনি।