নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে রিফাইনারি স্থাপনে পিছু হটল সরকার
- ৩২৪ কোটি টাকার প্রকল্প সাত বছর পর স্থগিত
- হচ্ছে না কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যু উৎপাদন
- প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি- জুন ২০২১
- ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৯.৭৩ কোটি টাকা
- কেনা গাড়ি, জীপ, ট্যাংক লরি ও পিক-আপ অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে
- প্রকল্পটি স্থগিত করা হলেও নতুন প্রকল্প নিতে সমীক্ষা করছে শিল্প মন্ত্রণালয়
বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি চিনির চাহিদা মেটাতে একটি উন্নত মানের রিফাইনারি স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে সরকারি একটি রিফাইনারি স্থাপন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের মাধ্যমে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পের আংশিক কাজ হলেও সাত বছর পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি স্থগিত করে নতুন প্রকল্প নিতে সমীক্ষা করছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এই সমীক্ষার আবারও নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে বলে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
৯১ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই মিলটির উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) 'নর্থবেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদন ও সুগার রিফাইনারি স্থাপন' প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।
সুগার রিফাইনারি স্থাপনের মাধ্যমে 'র' সুগার পরিশোধন করে সাদা চিনির চাহিদা মেটানো ও বিদ্যুত উৎপাদন করে বিক্রির মাধ্যমে মিলটিকে লাভজনক করতে এই পরিকল্পনা করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সমুদ্র বন্দর থেকে মিলটির দূরত্ব অনেক বেশি ও আখের ছোবড়া থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে খরচ বেশি হওয়ায় শঙ্কা থেকে প্রকল্পটি থেকে সরছে সরকার।
প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৩২৪.১৮ কোটি টাকা।
শুরুতে প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর।
তবে সংশোধনের পর মেয়াদ প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটি স্থগিত করে, চিনি কলটির নতুন সমীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সরকারের প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, চিনি উৎপাদনে আখের রস সংগ্রহের পর কলটির আখের ছোবড়া থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়, যাতে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবে মিলটি।
ছোবড়া থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের মাধ্যমে লাভজনক করা সম্ভব হবে বলেও মনে করা হয়।
"নর্থবেঙ্গল চিনি কলটি থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার, যাতে কম দামে বিদ্যুত পাওয়া যাবে।
তবে চিনি কলে উৎপাদিত বিদ্যুতে খরচ বেশি হবে, আর সারা বছর ছোবড়া পাওয়া যাবে না, ফলে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা কার্যকর হবে না বলে মনে করছেন নর্থবেঙ্গল সুগার মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হুমায়ূন কবির।
তিনি বলেন, চিনি কলটির আশপাশে কোনো নদী বা নদীবন্দর নেই, আমদানি করা 'র' সুগার সড়ক পথে মিলে আনতে হবে, যাতে ব্যয় আরও বাড়বে। এই কাঁচামাল রিফাইন করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। উৎপাদন খরচ বেশি হলেও বাজারের দামেই চিনি বিক্রি করতে হবে।"
'র' সুগার আমদানিকারকরা-ই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রক
সরকারি চিনি কলগুলো আখ মাড়াইয়ের পর সংগৃহীত রস থেকে চিনি উৎপাদন করে। সরকারি ১৫টি চিনিকল আগে থেকে আখ থেকে চিনি উৎপাদন করে আসছে।
কখনো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আখ চাষ করে আবার কৃষক থেকে আখ কিনে চিনি উৎপাদন করে মিলগুলো।
অন্যদিকে বেসরকারি চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো 'র' সুগার আমদানির মাধ্যমে পরিশোধন করে চিনি উৎপাদন করে।
দেশের সিটি গ্রুপ, এস আলম, দেশবন্ধু গ্রুপ, ইউনাইটে গ্রুপ ও আব্দুল মোনেম গ্রুপ চিনির বাজারের বড় নিয়ন্ত্রক।
দেশে বর্তমানে ছয়টি চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে চিনি উৎপাদন করে। চিনি শিল্পের বাজারের নিয়ন্ত্রক বেসরকারি খাতের এই উদ্যোক্তারাই।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ টন। যার মধ্যে সরকারি চিনি কলগুলো এক লাখ টনের চেয়ে কম চিনি উৎপাদন করতে পারে।
আর ১৭ লাখ টনের মতো চিনি আমদানি করা কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত হয়।
কয়েকটি চিনি মিলের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আখ থেকে চিনি উৎপাদন বেশ ব্যয়বহুল। কারণ আখের রস থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখন চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
যার কারণে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় বছরের পর বছর লোকসান গুনছে চিনিকলগুলো।
প্রকল্পটির অগ্রগতি ও ব্যয়
সাত বছর আগে 'নর্থবেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদন ও সুগার রিফাইনারি স্থাপন' প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পে অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ।
আর আর্থিক ব্যয়ের অগ্রগতি ২.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৩২৪.১৮ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৯.৭৩ কোটি টাকা।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রায় মূলধন ব্যয় ধরা হয় ৩০৮.০৮ কোটি টাকা। এই মূলধন ব্যয় থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি, সুগার রিফাইনারি ও কো-জেনারেশনের পূর্ত কাজ ও যানবাহন ক্রয় অর্ন্তভুক্ত।
সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য ইতোমধ্যে জীপ, ট্যাংক লরি ও ডাবল কেবিন পিক-আপ কেনা হয়েছে।
এছাড়াও প্রকল্পের কাজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়েছে। তবে এখন প্রকল্পটি স্থগিত করায় জিনিসপত্র অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তাবের উপর চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই সভায় শর্ত সাপেক্ষে বর্তমান অবস্থায় প্রকল্পটি স্থগিতের সুপারিশ করা হয়।ওই সভায় প্রথম সংশোধিত এই প্রকল্পটি দ্রুত সমাপ্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ওই সভায় বলা হয়, নর্থবেঙ্গল চিনি কলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য একটি সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণপূর্বক পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা পরীক্ষা সম্পন্ন করবে।
নর্থবেঙ্গল চিনি কলের আয়-ব্যয়ের হিসাব
নর্থবেঙ্গল চিনি কলটির অবস্থান নাটোরের লালপুরে। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। মিলটির কল এলাকার আয়তন ৩২৯ বর্গ কিলোমিটার আর মোট চাষের জমি ২২৭২৯ হেক্টর। আখের রস থেকে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি বাই-প্রডাক্ট হিসাবে মোলাসেস, ব্যাগাস ও প্রেসমাড উৎপাদন করে।
২০২০ সালের ৩০ জুন হিসাব অনুযায়ী, মিলটির বর্তমান ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ মিলিয়ে মোট সম্পদ রয়েছে ১৬১.৮৪ কোটি টাকা। মিলের সম্পদ রয়েছে ১৫৩.৮৩ কোটি টাকা আর ফার্মে সম্পদ রয়েছে ৮ কোটি টাকা।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, চিনি মিল ও ফার্ম থেকে মোট আয় হয়েছে ৮১.৬৪ কোটি টাকা। কস্ট অব গুডস সোল্ড ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে লোকসান হয়েছে ৮৬.১৭ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরে লোকসান ছিল ৯৪.৫৭ কোটি টাকা।
যার মধ্যে শুধুমাত্র মিল থেকে লোকসান হয়েছে ৮২.৯২ কোটি টাকা আর ফার্ম থেকে লোকসনা ৩.২৫ কোটি টাকা।
বড় লোকসানের বিষয়ে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হুমায়ূন কবির বলেন, "চিনি যে দামে বিক্রি করা হয়, তার চেয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। বাজারে চিনির দামে ভারসাম্য রাখতে বেশি খরচ হলেও চিনির দাম বাড়ানো যাচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "কৃষি ফসল উৎপাদনে দেশের অনেক অগ্রগতি হলে আখ থেকে বেশি চিনি পাওয়া যায়, এমন জাত এখনো উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়নি। বরং দেশীয় জাতের আখ থেকে চিনি রিকভারি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আখ চাষ আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় বেশি দামে আখ কিনতে হয়।"
তিনি বলেন, "সরকারি চিনি কলে লোকসানের বড় কারণ হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। শত শত কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে লোকসানের পাল্লা বাড়ছে।"
তিনি জানান, "নর্থবেঙ্গল চিনিকলে সর্বশেষ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান হবে। যার মধ্যে ৮৫ কোটি টাকায় ঋণে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। সেই হিসাবে সুদের ভার না থাকলে লোকসানের ভার হ্রাস পেতো।"