পাটের দামে খুশি কৃষক, কম উৎপাদনে শঙ্কায় পাটকলের মালিকরা
সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়া এবং বন্যার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় পাট চাষিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছিল। তবে ভালো দাম পাওয়ায় এ হতাশা কেটেছে।
অন্যদিকে, পাটের এই বাড়তি দাম এবং কাচা পাট রপ্তানি হওয়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী পাট না পাওয়ার শঙ্কায় ভুগছে বেসরকারি পাটকলগুলো।
যশোর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় মানভেদে প্রতি মন পাট বিক্রি হচ্ছে ২৭০০ টাকা থেকে ২৯০০ টাকায়। কোথাও কোথাও তিন হাজার টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে, যা এক মাস আগেও ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা ছিল।
কৃষক, ব্যবসায়ী, পাটকলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর বন্যা, কোভিড-১৯ ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে পাটের উৎপাদন কমেছে। এবারের উৎপাদন স্থানীয় চাহিদার তুলনায় কম। এর মধ্যেও চলছে কাঁচা পাটের রপ্তানি। এসব কারণে পাটের দাম এবার বেশি বলে জানা গেছে।
পাটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদন হয় যশোরে। যশোরের অন্যতম বড় মোকাম খাজুরার হাটে গত সোমবার পাট বিক্রির সময় এনায়েতপুর গ্রামের পাটচাষী শাহিন হোসেন বলেন, '৫ মন পাট বিক্রি করেছি ২৯০০ টাকা দরে।'
'সরকারি পাটগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে পাটের দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু ভালো দামের কারণে এই শঙ্কা কেটেছে,' বলেন তিনি।
বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের কৃষক রফিকুল বিশ্বাস জানান, ৫ বিঘা জমিতে চাষ করে বিঘাপ্রতি ১০-১২ মণ ফলন পেয়েছেন। ২৭০০ টাকা মন হিসেবে পাট বিক্রি করেন তিনি।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চরবাটিয়া গ্রামের পাট ব্যবসায়ী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, 'বন্যার আঘাতে পাটের উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু পাটের ভালো চাহিদা রয়েছে। যে কারণে দাম বেড়েছে।'
তবে যশোরে বন্যার আঘাত না লাগায় সেখানে পাটের ভালো ফলন হলেও বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সারা দেশে ৮২ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ হিসেবে ৭ দশমিক ২৬ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। বাড়তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবার তা পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এবার আবাদি জমির মোট ১৩ শতাংশের পাট নষ্ট হয়েছে। গত বছর দেশে ৬৮ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়।
বগুড়ার হাসান জুট মিল ও হাসান জুট অ্যান্ড স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম শাফিকুল হাসান জুয়েল বলেন, 'গত বছর যে মানের পাট ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায় কিনেছি, তার দাম এখন ২৬০০ থেকে ২৭০০ টাকা। দুটি মিলে প্রতিদিন পাট প্রয়োজন হয় ৬৫ থেকে ৭০ টন, দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে।'
আফিল গ্রুপের যশোরে আফিল উইভিং জুট মিলের ৪টি ইউনিট রয়েছে। গ্রুপের পরিচালক মাহবুব আলম লাভলু বলেন, 'আমরা প্রতি বছর যশোর ও ফরিদপুর জেলা থেকে পাট সংগ্রহ করি। এখানকার উৎপাদিত পাটের মান ভালো। এবারও আমরা বিপুল পরিমাণ পাট কিনছি। এবার পাটের উৎপাদন কম; দামও বেশি।'
কাঁচা পাট রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ দাবি মালিকদের
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর কাঁচা পাট রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এই চিঠিতে সংগঠন দুটি জানিয়েছে, স্থানীয় জুটমিলগুলোর চাহিদার তুলনায় এ বছর অন্তত ১০ লাখ বেল কাঁচা পাটের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় রপ্তানি অব্যাহত থাকলে ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে। পাটের অভাবে জানুয়ারির দিকে হয়তো অনেক কারখানা পণ্য তৈরি করতে পারবে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই মাসে যে পরিমাণ কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে, তা আগের অর্থবছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৫৮.৫৬ শতাংশ বেশি।
সংগঠন দুটির দাবি, এক টন কাঁচা পাট রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, এক টন পাটপণ্য রপ্তানি করলে আয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। এক টন পাট রপ্তানি ৫-৬ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়, যেখানে ১ টন পাটপণ্য রপ্তানি করতে কর্মসংস্থান হয় ৭০-৮০ জন লোকের।
এজন্য সংগঠনের নেতারা দাবি করেছেন, প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর ২৫০ ডলার রপ্তানি শুল্ক নির্ধারণ করা, লাইসেন্সবিহীন অসাধু ব্যবসায়ীর পাট মজুদ হতে বিরত রাখা, আড়দারদের কাছে ১ হাজার মন পাট ১ মাসের বেশি না রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে।
বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ভারত, ব্রাজিল, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশে পাট রপ্তানি হয়। তবে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ার কারণে পাট রপ্তানি করলে মিলগুলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে বন্ধ করে দিতে হবে বলে জানান সংগঠনের নেতারা।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বন্যা, কোভিড, আম্ফান-সহ বিভিন্ন কারণেই এবার উৎপাদন কম হয়েছে। এই মুহূর্তে পাট রপ্তানিতে লাগাম না টানলে আমরা জানুয়ারিতে গিয়ে পণ্য তৈরির জন্য পাটই পাওয়া যাবে না। তখন কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'বাড়তি দামের কারণে ইতোমধ্যেই প্রোডাক্টের দামও বেড়ে যাবে। এরও একটা প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে।'
জানা গেছে, দেশে এখন পাটকলের সংখ্যা ২৫৯টি। যেখানে প্রায় ২ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এখান থেকে বছরে ৬.৭০ লাখ টন পাটপণ্য রপ্তানি করে আয় হয় ৫২০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।