পাটে ব্যবসা দেখছে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো
রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়তে থাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলো লিজ নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশের কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাণ গ্রুপ, বে গ্রুপ এবং আকিজ গ্রুপ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। এছাড়া ভারতের দুটি এবং লন্ডনের একটি পাটকলও সরকারি পাটকলে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি ১৪টি পাটকলের ইজারা পাওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে ২৪টি কোম্পানি মোট ৫৮টি দরপত্র জমা দিয়েছে। দরপত্র ছাড়া হয়েছিল ১৭টি পাটকলের জন্য।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইমরান আহমেদ বলেন, শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ছাড়াও নতুন উদ্যোক্তারাও যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ দেখিয়েছেন, যা খুবই ভালো লক্ষণ।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আশা করছি এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে পাটকলগুলো আগামী বছরের শুরুর দিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হবে।'
বছরের পর বছর লোকসান দিতে দিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলো প্রাথমিকভাবে ৫ থেকে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হবে। পরবর্তীতে ইজারার মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকবে।
ইতিমধ্যে পাট ব্যবসায় শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে আকিজ গ্রুপ। তবে পাট খাতে নতুন নাম লেখাতে চাচ্ছে প্রাণ। তারা অন্যান্য পাটকলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা চালাবে।
প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা বাংলাদেশ থেকে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করে অনেক আলু রপ্তানি করি। বিভিন্ন দেশে শপিং ব্যাগও রপ্তানি হয়। বিদেশি ক্রেতারা এখন পাটের ব্যাগ চাচ্ছে। এছাড়াও জুট ডাইভারসিফাইড পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
'শপিং ব্যাগের পাশাপাশি পাট দিয়ে নানা ধরনের প্রোডাক্টস তৈরির পরিকল্পনা করছি। যেমন জুট ব্যাট প্লান্টেশন নতুন টেকনোলজি, এটা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বিদেশে প্রচুর রপ্তানি করতে পারব।'
খাদ্য উৎপাদন শিল্পের অন্যতম বড় নাম প্রাণ গ্রুপ। শিল্পগোষ্ঠীটি উত্তর আমেরিকা ও কানাডাসহ ১৪০টিরও বেশি দেশে নিজেদের পণ্য রপ্তানি করে।
প্রতিষ্ঠানটি এখন রপ্তানির লক্ষ্যে পাটশিল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
'বাংলাদেশ জুট মিলস' লিজ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন জানিয়ে ইলিয়াস মৃধা বলেন, 'আমরা এখন ১৪০টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছি। পাট আমাদের পণ্যের প্যাকেজিংয়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
'আমরা কারখানাটি লিজ পেলে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করব, যাতে নতুন করে তিন হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। মিলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। রাস্তা, শেড, ভবন ও মেশিনারিজে ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন হবে।'
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে পাটপণ্যের বিশাল সম্ভবনা রয়েছে। তবে লাভ করতে হলে পণ্য বৈচিত্র্য আনতে হবে।
আকিজ জুট মিলস সুনামের সাথে ব্যবসা করছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন ডাইভারসিফাইড পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে।
পাটখাতে আবস্থান আরও দৃঢ় করতে আকিজ গ্রুপও সরকারি পাটকল লিজ পেতে আবেদন করেছে বলে জানা গেছে মন্ত্রণালয় সূত্রে।
এ বিষয়ে কথা বলতে আকিজ গ্রুপের কর্মকর্তাদের কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
বে গ্রুপ ইজারা নেওয়ার জন্য আবেদন জমা দিলেও কোম্পানিটির শেষ পর্যন্ত ইজারা নেওয়ার সম্ভাবনা কম বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
কেন ইজারা দেওয়া হচ্ছে
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে বিজেএমসি'র নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকল ছিল ৩২টি। এর মধ্যে ৫টি পাটকলের মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল।
২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চালু ছিল ২৬টি পাটকল। কিন্তু পাটকলগুলো অনেক বছর লোকসান ও দেনায় ডুবে ছিল।
অদক্ষতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে বহু বছর ধরে লোকসান ও মূলধন ঘাটতি দিয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলো।
অন্য দিকে, পাটশিল্পে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত পাটকলগুলো উচ্চ দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার জন্য ভাল মুনাফা করছে বলে জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের এপ্রিলে বেসরকারি খাতে পাটকল লিজ বা ভাড়া দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র জারি করে বিজেএমসি।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, নরসিংদীর ঘোড়াশালে অবস্থিত বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পাওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। পাটকলটি ঢাকার কাছাকাছি বলে এর জন্য বেশি আবেদন পড়েছে। বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পাওয়ার জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। পাটকলটি ১৯৬২ সালে ৭৭ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়।
সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়া কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় সে প্রস্তাব মূল্যায়ন করবে। তারপর কারিগরি ও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে ইজারাদারদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করবে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইমরান আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোকে বেসরকারিকরণের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এর ফলে দেশে ও বিদেশে পাট শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় লোকসান দিতে থাকা এই পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ ভালো ব্যবস্থাপনার অধীনে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো ভালো করছে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি পাটকলগুলোর বেসরকারিকরণ দেশের সোনালি আঁশকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করবে।
পোশাক শিল্পের উত্থানের আগে, আশির দশকে, পাট ছিল দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানিপণ্য।
২০২০–২১ অর্থবছরে ১.১৬ বিলিয়ন ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এটি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ইজারা নিতে আগ্রহী ভারত ও যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান
ভারতের মোহন জুট ও প্যাসিফিজ জুট এবং লন্ডনের জুট রিপাবলিক ইজারা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
পূর্বে রায়গড় জুট মিল নামে পরিচিত মোহন জুট রায়গড়ে অবস্থিত। এটি হেসিয়ান বস্তা, কার্পেট ব্যাকিং, জুট সয়েল সেভার ও ইয়ার্ন উৎপাদন করে।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের প্যাসিফিক জুট শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। জুট রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে—এর প্রধান কার্যালয় সেন্ট্রাল লন্ডনে।
ইজারাদাররা যা পাবে
টার্ম অফ রেফারেন্স (টিওআর) অনুসারে, ইজারা পাওয়া কোম্পানিগুলো এসব পাটকলের সম্পদ, জমি, বিদ্যমান সক্ষমতা ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবে। প্রয়োজন মনে করলে নতুন যন্ত্রপাতিও সংগ্রহ করতে পারবে। তবে সেসব যন্ত্রপাতি কেবল পাট ও পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
ইজারার শর্ত অনুসারে, ইজারাদাররা পাটকলের অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও জমির তত্ত্বাবধান করবে এবং তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কারখানা পরিচালনা করবে।
পাটকলের জমিতে শুধু পাট দ্রব্য এবং বিভিন্ন পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা যাবে।
লিজ নেওয়া সম্পত্তি বা এর কোনো অংশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কিংবা মধ্যস্থতাকারী—কারও কাছেই বন্ধক বা সাব-লিজ কিংবা ভাড়া দেওয়া যাবে না।
ইজারা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সরকার ইজারাদারের কাছে ইজারাকৃত পাটকল হস্তান্তর করবে।
পাটকলগুলোর সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা
বিজেএমসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি পাটকলগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার ৩৫২.৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে জমি, ভবন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র, পরিবহন যানবাহন ইত্যাদি।
ঢাকার পাটকলগুলোতে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯৮৪.৪১ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ আছে। চট্টগ্রামের পাটকলগুলোর স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৪৩৫.২৯ কোটি টাকা এবং খুলনার পাটকলগুলোর স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৪ হাজার ৬৬৬.১৯ কোটি টাকা।
নন-জুট মিলগুলোর স্থাবর সম্পদ রয়েছে ২৪৪.০৭ কোটি টাকার।